শ্রীলঙ্কার স্থানীয় সাংবাদিকরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না গলে দাপট দেখানো বাংলাদেশ দল কলম্বোয় এভাবে নেতিয়ে পড়ল কী করে! তাঁদের তো আর জানা থাকার কথা না যে, সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট বাংলাদেশের জন্য সব সময়ই কঠিনতম চ্যালেঞ্জ। আর সেই ম্যাচটি যদি হয় প্রথম টেস্টে পাঁচদিন সমানে সমান লড়াইয়ের গল্প, তবে পরেরটায় নিস্তেজ হয়ে পড়া বাংলাদেশ দলের ক্ষেত্রে এক রকম নিয়ম। পাঁচ দিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় শত্রু ক্লান্ত শরীর এবং মন।
এর ব্যতিক্রম যে কখনো ঘটেনি, তাও নয়।
গত বছর আগস্টেই পাকিস্তানের মাটিতে অবিশ্বাস্য ২-০ ব্যবধানে জিতেছে বাংলাদেশ। তবে হাতে গোনা এমন কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ক্লান্তি আর অবসাদে ভোঁতা হয়ে যায় নাজমুল হোসেনদের ‘স্কিল সেট’। টেস্ট অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণার আগে তাঁর কথাতে এর ইঙ্গিতও আছে, ‘প্রথম ইনিংসে বাজে ব্যাটিংয়ের পর ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন ছিল। আপনারা যদি প্রথম ইনিংসে দুই দলের ব্যবধান দেখেন, তাহলে বুঝবেন।
সত্যি বলতে, ওখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব ছিল।’
কিন্তু টেস্ট ম্যাচ চার ইনিংসের। এক ইনিংসের ব্যর্থতা পরে পোষানোও সম্ভব। বাংলাদেশ তা পারেনি, পারবে যে না, তা বোঝাও যাচ্ছিল।
কলম্বোয় প্রথমদিনের ধাক্কায় পথ হারানো বাংলাদেশ দলের বোলিং ইউনিট যাচ্ছেতাইভাবে ‘ফেল’ করে দ্বিতীয় দিনে। উইকেটের দোষ দেননি নাজমুল, সাফ জানিয়ে দেন, ‘আমরা বাজে বোলিং করেছি।’ প্রথম ইনিংসে বাজে ব্যাটিং এমন বাজে বোলিংয়ের প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশ দলের খেলা সরু চোখে অনুসরণ করা যে কেউ এই রসায়ন বুঝতে পারবেন। কিন্তু সেই বোলাররাই আবার তৃতীয় দিনে সফল হলেন কী করে? নাজমুলের মুখেই শুনুন, ‘বোলাররা ভালো করেছে।
উইকেটও দ্বিতীয়দিনের মত ছিল না।’ যেটা তিনি বলেননি, শ্রীলঙ্কার ব্যাটারদেরও দ্রুত রান তোলার তাড়া ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে একটি সত্য অকপটে স্বীকার করেছেন নাজমুল, ‘আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে তো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেই হয় না।’ এমন পরিস্থিতি মানে, ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপার। ম্যাচ শুরু হয় যেভাবে, শেষও হয় সেই মালগাড়ির গতিতে। সে অর্থে লড়াই হয় না। নাকি লড়াই করেন না খেলোয়াড়রা? এবারও কোন রাখঢাক করেননি তিনি, ‘আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে সে অর্থে কম্পিটিশন হয় না। এজন্য অনেক কিছুকে সামনে আনতে পারেন। তবে আমাদের খেলোয়াড়দের দায়টা সবচেয়ে বেশি।’
এই ‘দায়’ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উত্তরণের সিঁড়ি ঘরোয়া ক্রিকেট। কিন্তু সেখানে দুলকি চালে খেলা হয়। টেস্ট মর্যাদাপ্রাপ্তির সময়কালের তুলনায় ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে পারিশ্রমিক, অবকাঠামোর উন্নতি হয়েছে। অবশ্যই তা কাঙ্খিত উচ্চতা পায়নি। কিন্তু যেটুকু বেড়েছে, তার প্রাপ্য সন্মান কী রাখছেন ক্রিকেটাররা? পুরনো এই অভিযোগকে খেলোয়াড়দের দায়ের প্রসঙ্গ তুলে পরোক্ষে প্রত্যায়ন করে দিয়েছেন নাজমুল।
অবশ্য বাংলাদেশের ক্রিকেট বৈপরীত্যে ভরপুর! ঘরোয়া ক্রিকেট কঠিনতম চ্যালেঞ্জ জয়ের দীক্ষা দেয় না জেনেও এনামুল হকের প্রসঙ্গ উঠতে ভদ্রভাবে ঝাঁঝালো উত্তর দিয়েছেন নাজমুল, ‘এনামুল ভাই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে কতগুলো রেকর্ড গড়েছেন, আপনারা জানেন। উনার দুর্ভাগ্য যে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি।’ এটা সত্যি যে, এনামুল হক ঘরোয়া ক্রিকেটে যেখানে সেখানে রান করেন। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে যে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেন, সেটি তো গত এক যুগে কয়েক দফায় প্রমাণিত হয়েছে।
তবু কেন এনামুল হককে শ্রীলঙ্কায় পাঠিয়েছিলেন নির্বাচকরা। সবচেয়ে কেৌতুহলোদ্দীপক তথ্য হলো, টপ অর্ডারের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে এমন একজনের ওপর বাজি ধরেছেন নির্বাচকমন্ডলী, যাঁর টেস্ট সামর্থয বরাবরই প্রশ্নবদ্ধি ছিল। আরও অবাক করা ব্যাপার, দুই টেস্টের সিরিজের জন্য বাংলাদেশ স্কোয়াডে ওপেনার ছিলেন মাত্র দু’জন। ওদিকে ‘ওয়ার্কলোডে’র নাম করে চার পেসার দলে। অথচ শ্রীলঙ্কায় টেস্টে তিন পেসার খেলানো বিলাসিতা, বাংলাদেশও খেলায়নি। উল্টো, যাঁর কর্মঘণ্টা নিয়ে সবচেয়ে বেশি দুঃশ্চিন্তা, সেই নাহিদ রানা খেলে ফেললেন টানা দুটো টেস্ট!
কলম্বোর হার ইনিংস ব্যবধানে হলেও একটা লাভ হয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন নাজমুল হোসেন। দল নির্বাচনী ভাবনাও নজর কাড়ছে!