১৩ বছরের একরত্তি ছেলে কামিল আলীর সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। রক্ষা পায়নি দুই চোখও। ঘটনার ৯ দিন পরও ফুলে আছে চোখ দুটি। চোখের মনিতে ঝাড়ুর শলা দিয়ে খোঁচানো লাল দাগ।
কচি মুখখানিজুড়ে ক্ষত। হাত-পায়ে গজ কাপড়ের ব্যান্ডেজ।
এটি কোনো দুর্ঘনায় আহত শিশুর অবস্থার বর্ণনা নয়। শিশুটি নির্মম নির্যাতনের শিকার।
এমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে গত ৩০ জুন সুনামগঞ্জের ছাতকে। চুরির অপবাদ দিয়ে শিশুটিকে নির্মম নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, নির্যাতনের পর শিশুটিকে ‘যুবক’ দেখিয়ে মিথ্যা মামলাও দিয়েছে নির্যাতনকারীরা।
নির্যাতনের শিকার কামিল আলী ছাতক পৌর শহরের মণ্ডলীভোগ এলাকার পিকআপ ভ্যানের চালক সুহেল মিয়ার ছেলে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ, পুলিশ, শিশুটির পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অভাবের সংসার হওয়ায় শিশু কামিলকে শহরের ওয়াহিদ মার্কেটের নিচতলায় একটি সবজির আড়তে কাজে লাগিয়ে দেন তার বাবা সুহেল মিয়া। রমিজ আলী নামের এক ব্যবসায়ীর সবজির আড়তে কাজে যোগ দেয় শিশুটি। গত ৩০ জুন আড়তদার রমিজ আলীর দুই ছেলে মোস্তাকিন ও মোক্তাদির এবং তাদের সহযোগী ময়না, সুজন ও কাজল চুরির অপবাদ দিয়ে কামিলের হাত-পা বেঁধে মারধর শুরু করেন। তারা শিশুটিকে প্যান্টের বেল্ট দিয়ে শরীরে আঘাত করেন। এরপর শলার ঝাড়ু ও লাঠি দিয়েও হাত-পা বেঁধে মারধর করেন।
একপর্যায়ে ঝাড়ুর শলাকা ভেঙে দুই চোখের মণিতে খুচিয়ে রক্তাক্ত করেন। এভাবে তার ওপর নির্যাতন চলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। একপর্যায়ে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু এখানেই ক্ষ্যান্ত হননি অভিযুক্তরা। রাতে শিশুটির বয়স ২০ বছর দেখিয়ে শিশুটির বিরুদ্ধে চুরির মামলা দেওয়া হলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়।
সূত্র অনুযায়ী, পরদিন ১ জুলাই সুনামগঞ্জ শিশু আদালতে কামিল আলীকে জামিন শুনানির জন্য হাজির করলে আদালতের বিচারক মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ (জেলা ও দায়রা জজ) শিশুটিকে জামিন দেন। এ সময় শিশুটির শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে বিচারক পর্যবেক্ষণে জানান, শিশু অপরাধে জড়িত হলেও তাকে শারীরিক নির্যাতন করার অধিকার কারো নাই। শিশুকে নির্যাতন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরে বিচারক আগামী ১৫ দিনের মধ্যে শিশু কামিল আলীকে নির্যাতনকারীদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন পুলিশকে। এ ছাড়া নির্যাতিত শিশুটিকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সিভিল সার্জনকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। পরে শিশু কামিলকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল ও সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে গত ৮ জুলাই থেকে পরিবারের সঙ্গে বাসায় অবস্থান করছে। তবে এখনো নির্যাতনের ভয়াবহতার কথা ভুলতে পারছে না কোমলমতি শিশুটি। শরীরে অসংখ্যা আঘাতের কারণে এখনো ঠিকমতো ঘুমুতে পারে না। এ ঘটনায় নির্যাতনকারীদের শাস্তি দাবি করেছে শিশুটির পরিবার।
এদিকে এখন নির্যাতনকারীরা প্রভাবশালীদের দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে হতদরিদ্র শিশুটির পরিবারকে হুমকি-ধমকিও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নির্যাতিত শিশু কামিলের বাবা সুহেল মিয়া বলেন, ‘আমার অভাবের সংসার। ছেলেটি আড়তে কাজ করত। তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে তার চোখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়েছে। তার চোখ এখন অন্ধ হয়ে যেতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘নির্যাতনকারীরা এখন আপস করার জন্য হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। আমরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় আছি।’
শিশুটির মা কল্পনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে এখন ভালো করে দেখতে পারে না। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। এখন আপস করার জন্য আমাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে মূল অভিযুক্ত মোস্তাকিন ও মোক্তাদিরের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তাদের বাবা আড়তদার রমিজ আলী বলেন, ‘ছেলেটি ছাদ থেকে পড়ে আহত হয়েছে, কেউ মারধর করেনি। তবে শিশুটির চোখসহ শরীরে আঘাতের চিহ্ন কিভাবে হলো জানতে চাইলে তিনি জবাব না দিয়েই ফোন কেটে দেন।’
ছাতক থানার ওসি মো. মুখলেছুর রহমানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘ভাই আমি এটা নিয়ে এখন কথা বলতে পারব না। সুনামগঞ্জ জেলা অফিসে মিটিংয়ে আছি।’