আমিনুল হক শামীম। ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও ত্রিশাল উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরি কমিটির সদস্য। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পাতানো নির্বাচনও অংশ নেন। রয়েছে চব্বিশের ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর জুলুম নির্যাতন জড়িত থাকার অভিযোগ। ৫ আগস্টের পর তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও হয়। তবে সব পরিচয় মুছে দিয়ে তিনি এখন বিএনপি নেতা সাজতে চান। মুক্তি চান এসব হত্যা মামলা থেকে। সেজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেছেন।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গত বছরের ৫ আগষ্টের পর শামীমের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়। ময়মনসিংহে জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণসহ বিভিন্ন মামলায় আসামী করা হয় এই আওয়ামী লীগ নেতাকে। কিন্তু ওই মামলা থেকে নিজেকে নির্দোষ প্রমানের জন্য তিনি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। যেখানে তিনি নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘২০১৬ সালে আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগদান করি। এর আগে আমি জামালপুর লেখাপড়া করাকালীন প্রতিষ্ঠাতা ছাত্রদলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু বর্তমানে ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ব্যক্তিগত আক্রোশে আমাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হেনস্তা করছে। আমাকে অন্যায়ভাবে শহীদ সাগর হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলায় আসামি করা হয়েছে।’ এই অবস্থায় আবেদনটি তদন্তপূর্বক সুবিচারের প্রার্থনা করেন তিনি। তবে জুলাই হত্যা মামলার একজন প্রভাবশালী আসামী গ্রেফতার এড়িয়ে কিভাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে চিঠি দিয়েছেন তা নিয়ে ময়মনসিংহবাসীর কৌতূহলের কমতি নেই।
সূত্র আরও জানায়, শুধু জুলাই হত্যাকান্ড নয়, এর আগে ২০১৭ সালে পরিকল্পিত ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় ময়মনসিংহের ছাত্রলীগ নেতা শাওনকে। সাত বছর পার হলেও সেই হত্যা মামলার বাদি হতে পারেননি নিহতের পরিবারের কেউ। পুলিশ বাদী হয়ে তাদের মতই করেই লিখেছিলো মামলার এজাহার। এরপর মনগড়া চার্জশিট দেয়ায় আর বিচার পাননি শাওনের পরিবার। চার্জশিটে বলা হয়, ভুল করে পিস্তল থেকে গুলি বের হয়ে মৃত্যু হয় শাওনের। এখন গুঞ্জন উঠেছে, শাওন হত্যার সেই মামলার ফাইলটি থানা থেকেই গায়েব হয়ে গেছে। অদৃশ্য এক শক্তি পুরো মামলাটিকে শেষ করতে বিপুল টাকা খরচ করে গায়েব করে দেয় শাওন হত্যার ফাইল।
নিহত শাওনের বোন ফ্লোরা সাংবাদিকদের বলেন, শাওন হত্যা মামলার বাদি হওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাপ করেছেন পরিবারের প্রতিটি সদস্য। কিন্তু অদৃশ্য কারনে বারবারই তাদের বলা হয়েছে. ‘যেহেতু পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছে, সেহেতু আপনাদের বাদি হওয়ার প্রয়োজন নেই। যার কারনে গত সাত বছরে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন পরিবারের সদস্যরা। ৫ আগষ্ট ছাত্রজনতার অভূত্থানে পট পরিবর্তনের পর মামলার বাদি হওয়ার একজন পুলিশ সদস্য তাদের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু গত সাত বছরে পুলিশের সন্দেহজনক আচরনে হতাশ হয়ে এই বাহিনীর উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে তাদের। তাই নতুন করে এখনো সাড়া দিচ্ছেনা পরিবার।
জানা গেছে, শাওন হত্যার পেছনে থাকা সেই অদৃশ্য শক্তি ছিলেন আমিনুল হক শামীম। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগ নেতা শাওন হত্যার পর লাশ দাফন হয়। পরে সেই লাশ আবার কবর থেকে তুলে পোস্টমর্টেম করা হয়। এই হত্যা মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আমিনুল হক শামীমসহ মোট ৯ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। কিন্তু আমিনুল হক শামীম ময়মনসিংহ পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি এবং ঢাকা জেলা পরিবহন মালিক সমিতির সহ-সভাপতি। তার ছোটো ভাই একরামুল হক টিটু ময়মনিসিংহ পৌরসভায় প্রথমে মেয়র এবং পরে সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র ছিলেন। দলীয় এবং পারিবারিক এমন প্রভাব খাটিয়ে কৌশলে এসপি অফিস থেকে মামলার সেই ফাইল গায়েব করিয়েছেন শামীম। এ ব্যাপারে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পলাতক থাকায় আমিনুল হক শামীমের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া তার নাম্বারও বন্ধ পাওয়া যায়।
আর নথি গায়েবের ব্যাপারে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলার পুলিশ সুপার কাজী আকতারুল আলম বলেন, শাওন হত্যা মামলার ফাইল গায়েব হয়নি। এই মামলার বিষয়ে পুলিশের উচ্চমহলে আলোচনা হয়েছে। নিহতের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রেখে মামলাটি তদন্ত শুরু হয়েছে।
কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সফিকুল ইসলাম খান শফিক বলেন, আমিনুল হক শামীম সাগর হত্যাসহ সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের হওয়া মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। এছাড়াও তিনি একাধিক মামলার সন্দেহভাজন আসামি। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন, তবে গ্রেপ্তার অভিযান চলমান আছে।