নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার সান্যালপাড়া গ্রামে টিনের ছাউনির এক ছোট্ট ঘর। কর্দমাক্ত উঠোন পেরিয়ে যে ঘরের ভেতরে যাওয়াই দায়, কে জানত অজপাড়া গাঁয়ের এই ঘর থেকেই একদিন উঠে আসবে হকিতে দেশের উজ্জ্বল মুখ কনা আক্তার। অভাব, কষ্ট আর সমাজের কটু কথা পেরিয়ে যে কনা আজ সংগ্রাম, সাহস আর গর্বের নাম।
কনার বাবা আবু বক্কর পেশায় দিনমজুর। তার প্রতিদিনের কষ্টের আয়ে চলে ৬ সদস্যের সংসার। মা চামেলী বেগমও হাঁপিয়ে উঠেছেন সংসারের দুশ্চিন্তায়। স্বল্প আয়ে সংসারের ব্যয় মেটানই যেখানে কঠিন সেই পরিবারে খেলাধুলা মানেই এক বাড়তি বোঝা।
কনার মেজো বোন বিনা অসাধারণ ফুটবল খেলতো। স্কুল জীবনেই জেলা পেরিয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে। কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারেনি। আর্থিক টানাপোড়েন ও সামাজিক চাপ তাকে ৮ম শ্রেণীতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসায়। থেমে যায় তার খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন।
বড়বোন বিনার সঙ্গে খেলায় অংশ নিত কনা। তবে, বোনের বিয়ের পর খেলা বন্ধ হয়ে যায়। তবুও কনার মন পড়ে থাকত মাঠে। স্বপ্ন দেখতো বোনের চেয়ে ভালো খেলোয়াড় হওয়ার। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, বোনের মতো হাল ছাড়বে না সে। শুরু করে কঠোর পরিশ্রম।
শীতের কুয়াশা ঢাকা সকালে যখন পুরো গ্রাম ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন কনা ছুটে যেত মাঠে। বাবা-মা জানলে খেলায় বাধা দেবেন, এই ভয়েই লুকিয়ে অনুশীলন করত। সান্যালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেয় কনা। সেসময় তার পাশে ছিলেন স্কুল শিক্ষক কামরুল হাসান। সকল সহযোগিতার পাশাপাশি এই শিক্ষকই ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস।
২০২১ সালে শিক্ষক কামরুল হাসানের উদ্যোগে রাজশাহীতে বিকেএসপির (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) ট্রায়ালে অংশ নেয় কনা। বাড়ি থেকে ধার করা এক হাজার টাকা নিয়ে সেখানে গিয়ে হকি, জিমন্যাস্টিকস ও ফুটবলে অংশ নেয় এবং একসঙ্গে তিনটি খেলাতেই নির্বাচিত হয়।
হকি এবং জিমন্যাস্টিকস এ প্রথম হয় এবং ফুটবলে হয় ২৩ তম। কামরুল স্যারের পরামর্শে বেছে নেয় হকি। শুরু হয় কনার নতুন সংগ্রাম।
এদিকে মেয়ের বিকেএসপিতে সুযোগের খবরে একদিকে যেমন পরিবার খুশি হয় সেই সাথে পরে দুশ্চিন্তায়। কারণ ,ভর্তির জন্য প্রয়োজন ৩৫ হাজার টাকা। কনার পরিবারের জন্য এত টাকা যোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। কামরুল স্যারের সহায়তা, পরিবারের শেষ সম্বল ছাগল ও হাঁস বিক্রি করে কনা ভর্তি হয় বিকেএসপিতে। সেই ছোট্ট গ্রাম থেকে পা রাখে ক্রীড়া শিক্ষার মূল স্রোতে।
২০২১ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার দুইবছর পরই অনূর্ধ্ব ২১ দলের হয়ে এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) কাপ জুনিয়র টুর্নামেন্ট খেলতে দেশের বাইরে যায় কনা।
এরপর ২০২৪ সালে সিঙ্গাপুর ও ওমানে গিয়ে আরও দুইবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। সবশেষ ২০২৫ সালে চীনের দাজহুতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৮ এশিয়া কাপ হকিতে অংশ নেয় বাংলাদেশ। কনাও দলে জায়গা করে নেয়। ৭ টি ম্যাচে অংশ নিয়ে ২ টিতে ম্যান অফ দ্যা প্লেয়ার নির্বাচিত হয় দলের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিভাবান এই খেলোয়াড়।
কনার সাফল্যের পেছনে অসামান্য অবদান তার মা চামেলী বেগমের। তিনি বলেন, সমাজের মানুষের অনেক কটু কথা শুনেছি। সবাই বলত, মেয়ে খেলা শিখে কি করবে? অনেকবার বাধা দিয়েছি। কিন্তু মেয়েকে আটকে রাখতে পারিনি। অর্থের সংকট, সামাজিক বাধা সত্ত্বেও মেয়ের ইচ্ছে আর পরিশ্রমে আজকে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে। মেয়ে দেশের জন্য কিছু করতে পারছে এটাই আনন্দের।
শুরু থেকেই কনার পথচলায় পাশে ছিলেন তার শিক্ষক কামরুল হাসান। বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস। কামরুল হাসান বলেন, এই মেয়েটির মধ্যে নিষ্ঠা ছিল, চেষ্টা ছিল। আমরা চেষ্টা করেছি শুধু একটু পথ দেখিয়ে দিতে। ওর অর্জন আমাদের সবার সম্মিলিত স্বপ্নের ফসল। তবে এখনো ওর পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। মেয়েটার খরচ দেয়া ওদের জন্য কঠিন। বিকেসপিতে এখনো ১২ মাসের টাকা বাকি।
নিজের স্বপ্ন নিয়ে কনা জানায়, দেশের হয়ে খেলতে পারাটা অনেক বড় সম্মানের। আমি চাই আরও ভালো খেলতে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করতে। সবার দোয়া চাই, যেন আমার এই পথচলা থেমে না যায়।