একটি গ্রামীণ বাজারের নাম কাজিরবাজার। বৃটিশ আমল থেকে বাজারটি শুরু হলেও এখন বাজারটি একটি ধ্বংশস্তুপ। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করা বাজারটি এখন মরুভূমি ও লোকশূণ্য। সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার উমরপুর ইউনিয়নে ছিল বাজারটির অবস্থান। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরির্তনের এই যুগেও চালু করা সম্ভব হয়নি এই বাজারটি। তবে এর পেছনে রয়েছে এক অনিবার্য করুণ কাহিনী। সেই কাহিনীর কারণেই বাজারটি আজ বিলুপ্তপ্রায়। স্থানীয়দের বয়ানে উঠে এসেছে সেই অজানা গল্প। ভারতীয় নাগরিক শেখ নাসির উদ্দিনের “নাসির বিড়ি” বিক্রেয়কে কেন্দ্র করে বাজারটি আজ বিলুপ্ত প্রায়।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়, উপনিবেশিক শাসনের পূর্বে সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার উমরপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকা সৈয়দ মান্দারুকা গ্রামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন জমিদার ও মহাজনরা। তখনকার সময়ের ঐতিহ্যের সাথে মিল রেখে বাজারটির নাম রাখা হয় কাজির বাজার। প্রতিষ্ঠার পর অল্প দিনে জমজমাট হয়ে উঠে গ্রামীণ জনপদের একমাত্র এই বাজারটি। সপ্তাহে নির্দিষ্ট দুইদিন করে বাজারে বসতো হাট। এই দুইদিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি-পণ্য বেচাকেনা করতে অনেক দূর থেকে ছুটে আসতো ক্রেতা-বিক্রেতাসহ আশপাশ এলাকার বিপুল সংখ্যাক মানুষ। বাজার হয়ে উঠতো রীতিমত মিলনমেলা। প্রবাসী ও দেশের দূর-দূরান্তে জীবিকার তাগিদে অবস্থানরত মানুষ বাজারে এলে দেখ হলে হতো কুশল বিনিময়। একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে চলে যেত আধাবেলা।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এই বাজারের একজন প্রাচীতম ব্যবসায়ী ভারতীয় নাগরিক শেখ নাসির উদ্দিনের (নাসির বিড়ি) বিক্রি করে চলতো তার সংসারের চাকা। তখন সিলেট অঞ্চলে সাধারণ ধুমপায়ীদের কাছে (নাসির বিড়ি) বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখনও আছে। তবে আগের মতো নেই। কম পয়সায় বেশি বিড়ি দিয়ে “নাসির বিড়ির” রঙিন প্যাকেট সাজানো থাকতো অত্যন্ত আকষর্ণীয়ভাবে। ভারতীয় নাসির বিড়ির সেই রঙিন ও আকষর্ণীয় প্যাকেটে এখনও বাজারে পাওয়া যায়। প্রশাসেনর নাকের ডগায় উপজেলার বিভিন্ন বাজারে প্রতিনিয়ত বিক্রি হচ্ছে বুঙ্গার এই বিড়ি।
তবে কাজির বাজারের আলোচিত সেই ব্যবসায়ী দেশ স্বাধীনের পর অবৈধভাবে ভারতীয় পণ্য বেচা-কেনা নিষিদ্ধের আইন সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। কারণ তখনকার সময় বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ ছাড়া এত জনপ্রিয় আর কোন সংবাদ মাধ্যম ছিল না। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিয়ে আসা তখন ভারতীয় বুঙ্গার মালামাল আটকে পুলিশের সদর দফতর থেকে স্থানীয়ভাবে দেশব্যাপী অভিযানের আদেশের ঘোষণাটি তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ বেতার প্রচার করলেও সেই বিষয়ে অবগত ছিলেন না কাজির বাজারের সেই বুঙ্গা ব্যবসায়ী।
প্রতিদিনের মতো বুঙ্গার মাল কাজির বাজারে বিক্রি করতে গেলে খবর আসে বাজারের পাশে বাসিয়া নদীর নিকটে অবস্থিত বিশ্বনাথ থানা পুলিশের কাছে। বুঙ্গা ব্যবসায়ী তৎকালীন বালাগঞ্জ বর্তমান ওসমানীনগর থানার বাসিন্দা হওয়ার কারণে বিশ্বনাথ থানা পুলিশের হাতে আটক ব্যবসায়ীকে নিয়ে ঘটে লঙ্কাকাণ্ড। বিশ্বনাথের পুলিশ বালাগঞ্জের ব্যবসায়ীকে আটক করার বৈধতা নিয়ে ফুঁসে উঠে স্থানীয় এলাকাবাসী। অভিযানে আসা পুলিশ সদস্যদের কাছে জানানো হয়, এই ব্যবসায়ীকে আটক করতে পারেন না। এতে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে। পুলিশের হাতে আটক ব্যবসায়ী ও তার মালামাল ফেরত দিতে এলাকাবাসী পুলিশের প্রতি জোড় অনুরোধ করেন। এতে আটক ব্যবসায়ী ও জব্দকৃত মালামাল পুলিশ দিতে রাজি না হলে এলাকাবাসীর সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বাঁধে।
বাজারের নিকটেই বিশ্বনাথ থানা থাকায় পুলিশ মুহূর্তেই জনবল বৃদ্ধি করে। তাতে এলাকাবাসী আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। অভিযানে আসা প্রতিটি পুলিশ সদস্যের প্রতি চড়াও হয়ে উঠে এলাকাবাসী। পুলিশের সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ, আগুন ও ইটপাটকেল এবং রাবার বুলেটের আঘাতে কাজির বাজার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। স্থানীয়দের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও দফায়-দফায় রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। বারবার বুলেটের আঘাতে সে সময়য় অন্তত ২৫০ জন নারী-পুরুষও শিশু আহত হয়েছিল। তবে সে দিন কোন নিহতের ঘটনা ঘটেনি। পরবর্তীতে পুলিশের উপড় হামলা করা না করা নিয়ে এলাকার দুই পক্ষের বিরোধে এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
পুলিশের ওপড় হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তৎকালীন সময়ে কাজির বাজার এলাকায় পুলিশ রেড এলার্ট জারি করে। বাজারের দুটি অংশে অস্থায়ীভাবে বসানো হয় পুলিশ ক্যাম্প। এতে জনসাধারণের পুলিশি ভীতিতে জনমানবহীন শুনশান হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। বাড়িতে আয় রোজগারের কোন মানুষ না থাকায় বিপাকে পড়েন গৃহবধূরা। আতঙ্কে দিন কাটে তাদের। ধীরে-ধীরে ভেঙে পড়ে বাজার ব্যবস্থা। এলাকায় তৈরি হয় পক্ষ-বিপক্ষ। ধস নামে বাজারে। হামলা পরবর্তী সময়ে জুড়াতালি দিয়ে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাজারটি সচল রাখা সম্ভব হলেও এখন আর এই বাজারে কোন লোকজন যায়না।
কাজির বাজারের ষাটোর্ধ্ব আবদুল নূর বলেন, সপ্তাহে দুদিন শুক্রবার-রবিবার বাজার বসতো। নাসির বিড়ি বিক্রিকে কেন্দ্র করে পুলিশের সাথে এলাকাবাসীর সাথে মারামারি ঘটনায় বাজারটি আজ ধ্বংস হয়েছে। আগে কী সকাল কী সন্ধ্যা। একটা সময় সপ্তাহে বাজারবার এলে হাজার হাজার লোকের সমাগম হতো বড় বাজার হওয়ায় বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন ও পাইকাররা এসে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় পণ্য কিনে নিয়ে যেত। এখন কেবলই স্মৃতি।
বাজারটি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় বৃটিশ আমলের বেশ কিছু পুরতান স্থাপনার অমলিন স্মৃতি দৃশ্যমান হয়ে আছে। বাসিয় নদীর তীরবর্তী বাজারটি থেকে পশ্চিম দিকে উঁকি দিলেই গুচ্ছ গ্রামের একটি চমক ছবি দেখা যায়। পুরাতন দালানে ও আধাপাকা টিনসেড তৈরি দোকান ঘরগুলো আছে চরম অযত্ন অবহেলায়। শতবর্ষী কাজির বাজারের আশপাশের উল্লেখযোগ্য গ্রামগুলোর মধ্যে সৈয়দ মান্দারুকা, নিজ মান্দারুকা, পূর্ব মান্দারুকা, বাবন মান্দারুকা, শাবাজপুর, নিয়ামত পুর, কোনারাই, মজিদপুর, রশিদপুর, গুচ্ছগ্রাম, ধরারাই প্রভৃতি গ্রামের লোকজন স্থানীয়ভাবে এই বাজারের নিয়মিত ক্রেতা-বিক্রেতা ছিলেন।
বুড়ি বরাকের শাখা বাসিয়া নদীর তীরে অবস্থিত বাজারটির পাশেই রয়েছে,শারফিন শাহ (রহ:) নামে এক বুজুর্গের মাজার। তিনি সফরে এসে সেই ইদগাহে এক রাত্রি যাপন করায় এলাকাবাসীর কাছে কেন্দ্রীয় ইদগাহটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিলীন ও ধ্বংসস্তুপ বাজার নিয়ে এলাকাবাসীর আক্ষেপের শেষ নেই। পুনরায় বাজারটি চালুর ব্যাপারেও এলাকাবাসীর ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে, এমনটা জানালেন উমরপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য সৈয়দ মাসুদ আলী। েতিনি বলেন, কাজির বাজার শুধু বাজারই ছিলনা। এটি বৃটিশের একটি ঐতিহ্য ছিল। বাজারটি এভাবে ধ্বংস হবে তা কল্পনায় আসেনি।
সৈয়দ মান্দারুকা গ্রামের বাসিন্দা সাদিয়া ভেরাইটিজ স্টোরের প্রবীন ব্যবসায়ী জিল্লুল হক (৭৫) বলেন, ওসমানীনগরে প্রাচীন হাটগুলোর একটি হচ্ছে (কাজির বাজার) এটি শতবর্ষী ঐতিহ্য বহন করে। একসময়ে নৌপথে বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্য আসতো। এখানে বাজারের দিন হাজার হাজার লোকের সমাগম হতো। সপ্তাহে শুক্রবার-রবিবার হাটের ঐতিহ্য থাকলেও এখন হাটে মানুষ নেই। নেই আগের সেই জৌলুস। খালি পরিত্যক্ত ভবণ আর আগাছায় ভরে ঐতিহ্য ধরে প্রচীনতম শতবর্ষী সেই বাজারটির ভাঙা দালান ঘর গুলি।