বাংলার মাটি ও মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে কচু। এটি শুধু একপ্রকার সবজি নয়, বরং বাঙালির সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে এর এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দৈনন্দিন রান্নাঘর থেকে শুরু করে সাহিত্যের পাতায় পর্যন্ত কচুর সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আমাদের পিতৃপুরুষেরা কচুর নানা উপকারিতা ও স্বাদের কথা জানতেন, আর আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানও তার গুণাগুণের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, শুধু রান্নাঘরেই নয়, সাহিত্যেও কচুর বিচরণ কম নয়! এমনকি রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও কচুর উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। কচু খেতে খেতে যদি কারও রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে, তবে তা আদৌ অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই প্রবন্ধে আমরা কচুর নানা প্রজাতি, এর পুষ্টিগুণ এবং কীভাবে এটি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও স্থান পেয়েছে—সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করব।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে কচু একটি অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয় সবজি। এটি দামে সস্তা এবং সহজলভ্য হওয়ায় সাধারণ মানুষের খাদ্য তালিকায় বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কচুর প্রায় সব অংশই খাওয়ার উপযোগী, তবে কিছু কচু আপনা-আপনি জন্মায়, যা বনকচু নামে পরিচিত। এই বনকচু সবসময় খাওয়ার উপযোগী নয় এবং কিছু ক্ষেত্রে এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে।
কচুতে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। পুষ্টিবিদরা বলেন, কচু অত্যন্ত উপকারী একটি সবজি, যা রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সহায়ক। এতে রয়েছে আয়রন, যা শরীরে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সহায়তা করে। বিশেষ করে যাদের রক্তশূন্যতা আছে, তারা নিয়মিত কচু খেলে উপকার পাবেন। এছাড়াও, কচুতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ, যা অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুর জন্য উপকারী। এতে রয়েছে ফাইবার, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ই। কচু রক্তের কোলেস্টেরল কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর বাইরে কচুর আরও উপকারিতা আছে : ১. কচুতে ভিটামিন এ বিদ্যমান, যা চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি রাতকানা, ছানি এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাস প্রতিরোধে সাহায্য করে। ২. কচুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে, যা হজমশক্তি বাড়াতে সহায়ক। এতে থাকা পেকটিন কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে কার্যকর। ৩. কচুতে থাকা পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ৪. কচুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ৫. কচুতে ক্যালরির পরিমাণ কম এবং ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকে, ফলে এটি দীর্ঘক্ষণ পেট ভর্তি রাখে এবং অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ কমাতে সাহায্য করে। ৬. কচুতে ভিটামিন এ, সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বকের বলিরেখা, বয়সের ছাপ, ব্রণ ও দাগ দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়া, চুল পড়া রোধ ও চুলের বৃদ্ধিতে এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া, ফেনকচু উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শিরঃপীড়ার মহৌষধ। হাটেঘাটে, বন্দরে, অবন্দরে অনেক জায়গায় ফেনকচুর রসসহ নানা সালসার জলসা চলে আজকাল।
আমাদের পরিবারেও কচু অতি প্রিয় একটা খাবার। এই সিজনে আরও দুইতিন খেলেও গতকাল এক হালি সরস মুড়াকচু এনেছিলাম। আজ কচু শাখ খেলাম, একটা তরকারিও হলো। কী স্বর্গসুখে খেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমাদের দেশীয় এধরনের খাবারের কাছে ফাইভস্টার মেন্যু তুচ্ছ। পৃথিবীর অনেক বড়ো বড়ো নেতা, যোদ্ধা কতকিছু খেয়েছে, কত যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, কত যে শক্তিমান কিন্ত আমাদের রেসিপির কচুশাখ খাননি বলে জীবন অর্ধেক বৃথা! আমরা নানাভাবে কচু খাই। শাখ, ভাজি, বড়া, ঝোল- কতকিছু! কখনওবা নিরামিষ, কথনও মাছ দিয়ে যার মধ্যে ইলিশ ও চিংড়ি প্রশস্ত। আবার শুটকি মাছ দিয়েও, সেটা চ্যাপা শুটকি বা সিদল হতে পারে, হতে পারে পুটি মাছের শুকনো শুটকি যেটা সিলেটি ভাষায় ‘আলা’ শুটকি নামে পরিচিত। প্রায় এক হাজার প্রকারের ছোটো-বড়ো নানা মাপের কচু আছে বলে জানা গেছে। কন্দজাতীয় এই উদ্ভিদের জন্ম সম্ভবত ভারত ও মালয়েশিয়া অঞ্চলে। ভারতের বৃষ্টি ভেজা বনাঞ্চলে, ছায়াঘেরা প্রান্তরে, জলাশয়ের ধারে, গৃহস্থের সবজিবাগানে দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে জাত কয়েকটি বন্য কচু হলো: কাল্লাকচু, বনকচু, চরকচু, গুঁড়িকচু, আশুকচু, সরকচু ইত্যাদি।
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে প্রাপ্ত কচু হলো : কৃষ্ণকচু, রাধাকচু, পাতরামান (রাধাকচু জাতীয় ফাঁড়ি এক প্রজাতি), মানকচু, আন্নাকচু, ফেনকচু, মুড়াকচু, ওলকচু ইত্যাদি। আমাদের ছোটোবেলা বাংলা বর্ণমালা শিক্ষায় ‘ও’-তে ওলকচু শিখেছিলাম। আর কচুর বাইপ্রডাক্ট হিসেবে মুখি কচু ও লতি বা লতার জুড়ি মেলা ভার। সে আরেক মহাকাব্য- লতামঙ্গল। কন্দ থেকে অজস্র গাছ জন্মে ঝোপের মতো তৈরি হয়। সিলেটের বাইরে কচুর নামাবলি : ঝিঙে কচু, চিংড়ি কচু, ডাঁটা কচু, কাল কচু, বেগুনি কচু ইত্যাদি।
আজ দুপুরের খাবারে কচুর দুই আইটেম মনোজগতকে চাঙা করে দিল। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। সহধর্মিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে? হাসছ যে?” মনে মনে হয়ত ভাবলেন, দীর্ঘদিনের শিক্ষকতায় মাথা খেয়ে গেছে—একা একা হাসে, একা একা কথা বলে! যদিও কিছু বললেন না, তার চোখে অনির্ধারিত কৌতূহল। আমি মৃদু হেসে বললাম, “কচু খেতে খেতে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ছে।” তিনি আরও অবাক হয়ে বললেন, “কচু খেয়ে রবীন্দ্রনাথ! কীভাবে?”
রবীন্দ্রনাথ কেবল প্রকৃতির কবি নন, তিনি জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গে রস খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর সাহিত্যে আমড়াতলা থেকে কচুবন, সবকিছুরই উপস্থিতি দেখা যায়। কচুবনের প্রসঙ্গ আসে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-তে, যেখানে এক দস্যু তার প্রাণ নিয়ে পালিয়ে কচুবনে লুকানোর কথা বলে। আবার ‘কালমৃগয়া’-তে একই পরিস্থিতিতে বিদূষক আমড়াবনে লুকিয়ে থাকার কথা বলে। মূলত, কবি এখানে মজার ছলে ‘কচুবন’ ও ‘আমড়াবন’ ব্যবহার করেছেন অপ্রাসঙ্গিক স্থান বোঝানোর জন্য।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের দুটি অংশ তুলে ধরা যায়:
১. ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (চতুর্থ দৃশ্য)- গান: “প্রাণ নিয়ে তো সটকেছি রে”
সংগীতাংশ: “কচুবনে লুকিয়ে থাকি।” (৩)
২. ‘কালমৃগয়া’ (পঞ্চম দৃশ্য)- গান: “প্রাণ নিয়ে তো সটকেছি রে”
সংগীতাংশ: “আমড়াবনে লুকিয়ে থাকি।” (৫)
এই দুই রচনায় একই গান ব্যবহৃত হয়েছে, শুধু লুকিয়ে থাকার স্থান ভিন্ন। এটি রবীন্দ্রনাথের রসিকতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। তাহলে, কচু খেতে খেতে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়া কি খুব অস্বাভাবিক কিছু? বাঙালির জীবনে কচু যেমন অবিচ্ছেদ্য, রবীন্দ্রনাথও তেমনই চিরসঙ্গী। আমাদের যেভাবে মাঝেমধ্যে কচুশাখে লবণ বেশি হয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের দেমনটি হতো। একবার বাল্মিীকি চরিত্রে অভিনয়ের সময় রবীন্দ্রনাথ ভুল করে চশমা নিয়ে মঞ্চে উঠে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের মতো, আমরা তাঁর মতো । তিনি আমাদের লোক। তিনি নিজেও বলে গিয়েছেন, “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক।”
লেখক পরিচিতি
মিহিরকান্তি চৌধুরী
লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার সিলেট।