সময় বদলেছে, সমাজ ও সরকার পাল্টেছে, প্রযুক্তি এগিয়েছে কিন্তু কনু মিয়ার জীবন আটকে ছিল কারাগারে।
বিচার ছাড়াই ৩০ বছর দুই মাস ১৯ দিন কাটিয়েছেন, মানসিক ভারসাম্য হারানোর দায়ে। পরিবার ভুলে গিয়েছিল, রাষ্ট্রও রাখেনি খবর।
এখন তিনি ফিরেছেন লাখাই উপজেলার সিংহগ্রামে জীবন্ত প্রমাণ হয়ে, কেমন নিষ্ঠুর হতে পারে সহানুভূতির অভাব। তিনি সিংহগ্রামের বাসিন্দা, পিতা মৃত চিনি মিয়া।
ত্রিশ বছর ধরে তিনি বন্দি ছিলেন কোনো সাজা বা রায় ছাড়াই। মানসিক অসুস্থতার কারণে মামলার কার্যক্রম স্থগিত ছিল। পরিবার তার খোঁজ নেয়নি, একসময়কার এক অজ্ঞাতপ্রায় নামহীন বন্দি কনু মিয়া এখন হয়ে উঠেছেন বিচারবহির্ভূত দীর্ঘ বন্দিত্বে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের প্রতীক।
সরেজমিনে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র চার শতক জমির ওপর ছোট চারটি টিনের ঘরে তিন ভাই পরিবার নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন।
বাড়ির উঠানে বসে থাকা কনু মিয়ার পাশে হাতপাখা করছেন ভাতিজি জোসনা বেগম। আশপাশের লোকজনও ফিরে পাওয়া স্বজনকে ঘিরে কথা বলছেন।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, দুই মায়ের ঘরে সাত ভাইবোনের মধ্যে কনু মিয়া ছিলেন ষষ্ঠ। দারিদ্র্যের কারণে পরিবার তার চিকিৎসাও করাতে পারেনি। এখন মাঝেমধ্যে অসংলগ্ন কথা বলেন। পরিবার বলছে, চিকিৎসা প্রয়োজন, কিন্তু সামর্থ্য নেই।
বড় ভাই নসু মিয়া বলেন, “ও ঢাকায় কাজ করত, তখন বয়স ২৫। জ্বরে অসুস্থ হয়ে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরে।
১৯৯৫ সালের ২৫ মে হঠাৎ ঘরে ঢুকে মায়ের গলায় কোদাল দিয়ে কোপ দেয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মা মারা যান। পরে পুলিশ তাকে আটক করে।”
“আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তখন কোন মামলা দায়ের করা হয়নি। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। প্রথমে সিলেট, পরে হবিগঞ্জ কারাগারে রাখা হয় কনু মিয়াকে।
কারাগারে যাওয়ার দশ বছর পর এক মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দির মাধ্যমে জানতে পারি সে জীবিত। বিশ বছর পর গিয়ে একবার দেখে এসেছি,” বলেন তিনি।
“এখন আমরা সবাই মিলে সেবা করছি। ভাই বলে কথা, ফেলে দিতে পারি না। তবে চিকিৎসায় সহযোগিতা দরকার। রাতে আমার পাশে ঘুমায়, কিন্তু ঘুমাতে ভয় লাগে।”
চেষ্টা করেও কথা বলানো যাচ্ছিল না কনু মিয়াকে। হঠাৎ বলে উঠেন, “ভালা লাগছে, আমেরিকাত থাকি আইছি তাই ভালা লাগতাছে।” এরপর কিছু অসংলগ্ন কথা বলেন, তবে জানান, মায়ের মুখ এখনও মনে আছে।
ভাতিজি জোৎনা বলেন, “তখন আমি ছোট ছিলাম, কিছু বুঝিনি। এখন ফিরে পেয়ে ভালো লাগছে, কিন্তু চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন। আমরা সকলের সহযোগিতা চাই।”
স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী মহিউদ্দিন আহমেদ রিপন বলেন, “জানতামই না গ্রামে এমন কেউ বিনা বিচারে ৩০ বছর ধরে জেলে ছিলেন। যদি বিচারও হতে তাহলে হয়তো এতদিনে সাজা খেটে বের হতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন
পরিবার অসহায় ছিল, কর্তৃপক্ষও অবহেলা করেছে। এখন তার চিকিৎসা নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব।”
কনু মিয়াকে দেখতে যাওয়া হবিগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, “সংবাদ শুনে দেখতে এসেছি। বিনা বিচারে ৩০ বছর কারাগারে— ভাবতেই কষ্ট হয়। দ্রæত চিকিৎসা দরকার।”
প্রতিবেশী ইদ্রিস মিয়া বলেন, “শুনেছিলাম চাচা মাকে খুন করে জেলে গেছে। পরে তাকে আমরা ভুলে যাই। এখন ফিরেছেন, কিন্তু আচরণ অস্বাভাবিক। পরিবারও কষ্টে আছে।”
হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার মোঃ মুজিবুর রহমান বলেন, “কনু মিয়াকে আলাদাভাবে রাখা হতো। সিলেট ও পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হতো। খাবার না খেতে চাইলে সেবক বন্দিরা কৌশলে খাওয়াতেন। চুল-নখ কাটা, স্নান করানো সব আমরা করতাম।”
তিনি আরও বলেন, “চলতি মাসের ৮ তারিখে লিগ্যাল এইড বিষয়ক সভায় ‘পাগল বন্দিদের’ প্রসঙ্গে কনু মিয়ার নাম উঠে আসে। অফিসার আগ্রহ নিয়ে উদ্যোগ নেন। অবশেষে জামিনের মাধ্যমে মুক্তি পেলেন। ২৭ বছরের চাকরিজীবনে এটি আমার সবচেয়ে বড় মানসিক তৃপ্তির জায়গা।”
লিগ্যাল এইডের প্যানেলভুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমএ মজিদ বলেন, “মানসিক রোগীদের বিচার স্থগিত থাকে। বিষয়টি সম্পর্কে উচ্চ আদালতও অবগত।
তবে আদালতে পরিবারের অনুপস্থিতিতে কনু মিয়া বছরের পর বছর কারাগারেই থেকে যান। শেষ পর্যন্ত লিগ্যাল এইড উদ্যোগ নিয়ে মুক্তি দেয়।”
গত ১৪ জুলাই হবিগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে লিগ্যাল এইডের প্যানেলভুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমএ মজিদ জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক জেসমিন আরা বেগম তা মঞ্জুর করেন।
পরদিন তাকে কারাগার থেকে বাড়ি নেওয়া হয়। পরে তাকে দুধ দিয়ে গোসল করানো হয়।
উল্লেখ্য, কনু মিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন নেই। স্থানীয়রা পরিচয়পত্র ও সরকারি ভাতা দাবির পাশাপাশি তার জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও মানবিক সহযোগিতা চান।