একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এখনো চোখে ভাসে, আমৃত্যু ভাসবে। কারণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংঘটিত সেই যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। ষাটের দশকে আমি ছাত্র ইউনিয়ন বৃহত্তর সিলেট জেলা, বর্তমান বিভাগের দপ্তর সম্পাদক ছিলাম। তাই সব ধরনের চিঠিপত্র গ্রহণ ও প্রেরণের দায়িত্ব ছিল আমার। কেন্দ্র থেকে গোপন নির্দেশনার চিঠি পাওয়ার পরই সেটা মহকুমা ও থানা কমিটি সমূহে প্রেরণ করি।
তখন কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম চলত গোপনে। তাই নগরীর কুমারপাড়াস্থ ন্যাপের অফিসেই চলত পার্টির কাজ। ন্যাপের সমর্থন ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি। আমাদের প্রশিক্ষণের খোঁজ নিতে তখন কুমারপাড়া অফিসে আসেন জননেতা পির হাবিবুর রহমান। তিনি বললেন, বড় ধরনের একটি ক্র্যাকডাউন হয়ে যাবে। ২৫ মার্চ রাতে সিলেটে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কারফিউর মাইকিং করানো হয় তৎকালীন এনাউন্সার সিকান্দারকে দিয়ে। কারফিউ চলাকালীন প্রথম গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে সিলেটে।
আমার বাসা তখন নগরীর শিবগঞ্জে। কারফিউর মধ্যে খছরু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি দেখেই ক্ষেপে উঠলেন- বললেন, তোমরা কাপুরুষ, কারফিউ ভেঙে অন্তত একটি মিছিল তো করতে পারতে। পরদিন ২৬ মার্চ ফজরের নামাজের সময় মীরাবাজারের যতরপুর রোডে মসজিদের সামনে গুলিবর্ষণ হয়। এতে নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার সময় শহিদ হন ন্যাপের কর্মী ফকির মিয়া। তিনিই একাত্তরের যুদ্ধে সিলেটের প্রথম শহিদ। এরপর শিবগঞ্জ আমার বাসার অনতি দূরে বর্তমান উপশহরের মুখে একটি লাল জিপ থেকে গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হন দি এইডেড হাইস্কুলের শিক্ষক জগলুল স্যার। বিকালে লামাপাড়ার মনন বাসায় আসেন। আমাকে বললেন, দ্রুত বাসা ছাড়তে। মজিদ নামের আরেকজন বললেন, বাসার সবাইকে লামাপাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে, একমাত্র আমাকে ছাড়া। আমি কারফিউর মধ্যেই পায়ে হেঁটে বের হলাম বাসা থেকে। তখন কুমার পাড়ায় গোলাপগঞ্জের প্রয়াত চেয়ারম্যান ইকবাল ভাইয়ের বাসা। পুরঞ্জয় চক্রবর্তী বাবলা, আবুল খয়ের ও আমি কুমার পাড়ার সেই বাসায় যাই। কিন্তু বাসায় কাউকে পেলাম না। এপ্রিলের ৪ তারিখ ইপিআর আসে সিলেটে। তারা আবহাওয়া অফিসে এবং অদূরেই শাহী ঈদগাহে ঘাঁটি গাড়ে। পরে আমরা চলে গেলাম ভারতের করিমগঞ্জে। ওখানে রিক্রুটমেন্ট, যুদ্ধাস্ত্রের ট্রেনিং শেষে, লিডারশিপের ট্রেনিং দেয়া হলো। নির্দেশনা দিলেন ইসমত চৌধুরী, কর্নেল এআর চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান, আবুল খায়ের চৌধুরী, রুহুল আমিন বাবুসহ অনেকেই। কুকীরতল-লাঠিটিলা হয়ে আমরা যুদ্ধ শুরু করি। দিলখোশ চা বাগানে কয়েকদফা অপারেশন চালিয়ে শত্রু প্রতিহত করি।
তবে সেখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে শহিদ হন আমার সহযোদ্ধা নবীগঞ্জের ইন্দ্র, সোনাওর, খালিক ও মাসুদ চৌধুরী চুন্নু। চুন্নু ৭ বোনের মধ্যে একমাত্র ভাই ছিলেন। এরপর অগ্রসর হই শমশেরনগরের দিকে। ওখানে শত্রুদের অবস্থান শক্তিশালী ছিল। সেখানেও যুদ্ধ হয় কয়েক দফায়। তখন খবর আসে মুন্সীবাজারে পাকবাহিনী হামলা করবে। খবর পেয়ে আমরা ওদিকে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নেই। কমান্ডার ফারুক ও মুহিতের নেতৃত্বে ৮৬ জন অগ্রসর হই। কিন্তু ইতোমধ্যে পাকবাহিনী মুন্সীবাজারে আর্টিলারি হামলা করে ফেলে। মৌলভীবাজারের ন্যাপ নেতা সৈয়দ মতিউর রহমান আমাদের নির্দেশনা দিতেন। এরপর আহাদ চৌধুরী আমাদের তারাপাশায় অস্থায়ী ক্যাম্পের ব্যবস্থা করে দেন। মৌলভীবাজারের ওই এলাকা দ্রুত আমরা শত্রুমুক্ত করে ফেলি। এরপর আমি কাজল ও ফখরুল মৌলবীবাজার কোর্টের দিকে অগ্রসর হই। সেখানে ক্যাম্পে গিয়ে দেখি ততক্ষণে তারা পালিয়েছে। তবে ক্যাম্পে বিপুল পরিমাণ উচ্চ ক্ষমতার বিস্ফোরক ফেলে গেছে। আমরা সেসব যুদ্ধাস্ত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে আসি। কিন্তু সেদিনই ঘটল যুদ্ধদিনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। গাড়ি থেকে আমাদের সহযোদ্ধাদের স্কুল ক্যাম্পে তাজা মর্টারশেলসহ উচ্চ ক্ষমতার বিস্ফোরকগুলো নামানোর সময় হঠাৎ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে আমার ২৭ জন সহযোদ্ধা শহিদ হন। সেদিন চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের তাজাপ্রাণ দেওয়ার মধ্য দিয়েই স্বাধীন হয় মৌলভীবাজার জেলা তথা, পূর্ব পাকিস্তান, জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
এখনো যুদ্ধ দিনের কথা মনে পড়ে, চোখে ভাসে। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে প্রাণ বাজি রেখে সম্মুখ সমরে যাওয়া, সহযোদ্ধাদের শহিদ হওয়া সেই স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার স্বপ্নকে ছুঁতেই পারেনি এদেশের মানুষ। উলটো স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দফায় দফায় অপশাসকের উত্থান। অপশাসনে স্বাধীনতা কী তা প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করতেই পারেনি এদেশের মানুষ। তবে কোনো অপশাসনই এদেশবাসী কখনোই মেনে নেয়নি, মেনে নেবেও না। অপশাসক-অপশাসন উৎখাতে এ মাটির মানুষ প্রতিবাদী ছিল, আগামীতেও থাকবে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের টানা অপশাসনে দেশবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এর আগে যুদ্ধপরবর্তীকালেও দেশে অরাজকতা তৈরি করেছিল। গত মেয়াদে তার পুনরাবৃত্তি ঘটে, অতীতকে ছাড়িয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে এবং পালিয়ে যেতে হয় খোদ সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ প্রধান, প্রধানমন্ত্রীসহ তাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের। যদিও আন্দোলনের নামে জ্বালাও পোড়াও, সম্পদ ধ্বংসের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
এদেশের মানুষ আবহমান কাল থেকেই চরম বৈষম্যবিরোধী। ব্রিটিশ-পাক-স্বদেশি অপশাসক কারো বৈষম্যই তারা মেনে নেয়নি, মেনে নেবেও না। ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর এ কথা বেমালুম ভুলে যায় শাসকরা। আর একের পর জনতা তাদের উৎখাত-উচ্ছেদ করেই ছাড়ে। তার পরও ইতিহাস থেকে তারা শিক্ষা নেয় না। শুধু অতীত নয়, আগামীতেও এর ধারাবাহিকতা থাকবেই। এবার ছাত্র-জনতা বৈষম্যবিরোধী স্লোগানে দেশে বিরাট পটপরিবর্তন এনেছে। এখন গোটা দেশবাসী বৈষম্যের চির অবসানের অপেক্ষায়। এতে যেন কোনো ভুল না হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এমনকি আজকের বৈষম্যবিরোধীরাই যদি কোনো কারণে আড়ালে-আবডালে বৈষম্যের পথে হাঁটে, সেই বৈষম্যের শেকড় উৎপাটনেও পিছপা হবে না, ইতিহাস তাই বলে।
সূত্র : দৈনিক যুগান্তর, প্রকাশিত ১৮ মার্চ ২০২৫
লেখক : আইনবিদ ও সাবেক সভাপতি, সিপিবি, সিলেট জেলা।