আসরের নামাজ শেষ হলেই আমার ডাক পড়তো মসজিদে। মিয়াছাব (ইমাম সাহেব) হুকুম দিতেন, কলা গাছের পাতা কেটে পানিতে সুন্দর করে ধুইয়ে ভাঁজ করে রেখে দিতে হবে মিনারের তলায়। কিছুক্ষণ পর ইফতারি আসা শুরু হবে। ওগুলো বাটতে হবে কলাপাতায়। বাটার কাজ ইমাম সাহেব নিজ হাতে করবেন, আমার কাজ কলাপাতা বিছানো পর্যন্ত।
মাগরিবের আগে আগে পাতিল হাতে করে অনেকে এসে পড়তেন মসজিদে। কারো পাতিলে খিচুড়ি, কারোটায় চানা (ছোলা ভুনা) বা ডালের বড়া। খিচুড়ির পরিমান বেশি থাকতো। কেউ কেউ ডালডা মাখানো খিচুড়ি পাঠাতেন। ৪-৫ বাড়ি থেকে আসা সব আয়োজন ছিল সবার জন্য। মাঝে মাঝে চানা-খিচুড়ির বাইরে নতুন আইটেম চলে আসতো। জিলাপি-লবংগ-নিমকি, সাথে রসগোল্লাও। বোঝা যেতো- এগুলো কারো বাড়িতে আসা নতুন ‘ইস্তারি’।
খেয়াল করতাম, জোহর-আছরে তেমন লোকজন হতোনা, কিন্তু মাগরিবের সময়, ‘ইস্তারি’ (সিলেটের লোকেরা ইফতারিকে ইস্তারি বলে) অসিলায় অনেকের সমাগম হতো। লাইন ধরে সবাই বসে পড়ার পর কলাপাতার উপর বেটে দেয়া হতো ইফতার। আজান থেকে নামাজের মধ্যবর্তি সময়ের মধ্যেই খাবার পালা শেষ হয়ে যেত। আমার উপর পরবর্তি দায়িত্ব থাকত, ব্যবহার না হওয়া কলাপাতা খালের মধ্যে ফেলে আসা এবং আগামী দিনের একই কাজের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেয়া।
আমার ছোট বেলায় এই ইস্তারি নেয়া এবং দেয়া নিয়ে আমাকে প্রায় সারাটা মাসই ব্যস্ত থাকতে হতো। পরিবারের যতো মহিলার বিয়ে হয়েছে তাঁদের সবার বাড়িতে ইস্তারি পাঠানো ছিল অনেকটা বাধ্যতামূলক। কারো নিজের ঘরের খাবারও যদি না থাকে, তাকে ধার করে হলেও মেয়ের বাড়িতে ইফতারি তাঁর পাঠাতে হত। এই ইফতারের পরিমানের উপর নির্ভর করতো স্বামীর বাড়িতে মেয়েটির অবস্থান। যতো বেশি ইফতার, ততো বড় হাসিমুখ মেয়েটির। এবং এ ইফতার শুধু মেয়ের স্বামী বা শশুড়-শ্বাশুড়ির জন্য নয়, তাঁর চৌদ্দগোস্টির উদরপুর্তির জন্য পর্যাপ্ত হতে হতো। সে সব ইফতারের অংশ আমাদের মসজিদে আসার পর তাঁর ভাগ মুসল্লীরাও পেতেন।
আমি ছোটবেলায় পেয়েছি আমার মা আর দাদীর বাপ, বোন, মামা বাড়ি থেকে আসা ইস্তারি। আমার মা’র মামা মাটিজুরা বা আমার দাদীর ভাই চন্দরপুর থেকে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এসে ব্যাগের ভেতর থেকে এক প্যাকেট জিলাপি আর এক প্যাকেট নিমকি বের করে রাখতেন। কেউ কেউ কিছুক্ষন থেকেই চলে যেতেন, কেউ আবার সন্ধ্যার পর ইফতার ও ভাত খেয়ে তারপর আবার ফেরত যেতেন।
আমি দাদার সঙ্গে প্রথম ইফতারি দিতে যাই আমার ফুফুর বাড়ি। তখন আমার ৭-৮ বছর বয়স। আমাদের গ্রাম পার হয়ে হাওড়ের মতো ৩-৪ মাইল লম্বা ধানক্ষেত পাড়ি দিয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছাতাম এক ময়রার বাড়ি। সে বাড়িতে গিয়ে জিলাপির অর্ডার দিলে বানিয়ে দিতো। ময়রার টিনের বাকসের মধ্যে থাকতো বানানো নিমকি, হাড়ির মধ্যে রসগোল্লা। ময়রা যতক্ষন ফুফুর বাড়ির ইফতারি জন্য জিলাপি প্যাচাতো, ততক্ষণ আমি রসগোল্লা দিয়ে নিমকি খেতে থাকতাম। আমার জন্য ছিল এটাই মহা ইফতার। সন্ধ্যাবেলা সবার সঙ্গে ইফতার খেতে বসে আবার এসব খাওয়া হতো, সঙ্গে থাকতো পাতলা খিচুড়ি।
রোজা মাস এলে আমাকে প্রায় সারা মাসই কুটুম বাড়িতে বাড়িতে থাকতে হতো। এক বাড়িতে ইস্তারি নিয়ে গেলে ফেরত আসতে অন্তত ২ দিনের মামলা। আমার যখন ১০-১১ বছর বয়স, তখন আমার নানা বাড়ি লন্ডনে চলে যায়। আমার মা তাঁর অন্য বিবাহিত ২ বোনকে নিয়ে দেশে থাকেন আর নানা-নানী বাকী ৫জন মামা-খালাদের নিয়ে লন্ডনে চলে যান। কিন্তু রমজান মাস এলে খালাদের বাড়িতে ইস্তারি দেয়া থেকে মাফ ছিল না। আমাকে যেতে হতো ডাবল ইফতার নিয়ে। প্রথমে আমার মা’র পক্ষ থেকে বোনের বাড়ি, পরে নানীর পক্ষ থেকে তাঁর মেয়েদের বাড়ি। আমাকে দেয়া হতো ‘ভারুয়া’ এবং গ্রামের বেকার কিছিমের কোনো লোক আমার গাইড এবং টাকার তত্ত¡াবধায়ক। তারপর আমরা হেঁটে হেঁটে বিয়ানী বাজার গিয়ে টুকরি ভর্তি করে অনেক কিছু কিনতাম। আমার ফুফুর বাড়িতে যে ইফতার দিতাম তার চেয়ে বেশি বাজেটের ইফতার যেতো খালাদের বাড়ি। কারন ওই ইফতারির টাকা আসতো লন্ডন থেকে। আমি মাথিউরা থেকে বিয়ানীবাজার, বিয়ানী বাজার থেকে লাতু-কাংলী পার হয়ে আমার বড় খালার বাড়ি ইটাউরীতে গিয়ে পৌঁছাতাম। জিলাপি, নিমকি, রসগোল্লা, খাজা, লবংগ- এসবের সঙ্গে ছোলাভাজি, ডালের বড়া, এসবও থাকতো। এটা ছিল মোটামোটী অভিজাত ইফতারি।
আমার শৈশবে সিলেটের একটা প্রত্যন্ত গ্রামের ইফতারির আয়োজন ছিল সংক্ষিপ্ত। মাগরিবের নামাজ সেরে আমরা বড়দের সঙ্গে ভাত খেতে বসে যেতাম। ভাত খেয়ে খানিক বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে তারাবির জন্য ছোটা এবং নামাজ পড়ে এসে ঘুম। ভোর রাতে আবার ফতা (সেহরী)’র জন্য ঘুমমাখা চোখে উঠে খেতে বসা।
বিবেচনা করে দেখি, সেইসব গ্রাম্য মুরুব্বিরা পুষ্টিবিদ্যা বা শরীরবিদ্যার কোনোকিছু না জেনেই খাবারের যে অভ্যাস করেছিল, তা ছিল যথেষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক। সারাদিন না খাওয়া পাকস্থলীর উপর বাড়তি চাপ না দেয়ার জন্য প্রথমে কিছু হালকা, নরম খাবার খেয়ে মাগরিবের নামাজের সময় নিজের অজান্তে কতগুলো যোগ ব্যায়াম করে, কিঞ্চিত বিশ্রাম নিয়ে বাকীটা খেয়ে পাকস্থলী ভর্তি করতো এবং তারও খানিক পরে এশার নামাজের সঙ্গে অতিরিক্ত আর ২০ রাকাত তারাবির নামাজ পড়ার সময় আরো কিছুক্ষণ যোগ ব্যায়াম করে হঠাৎ জমে যাওয়া ক্যালরীসমূহ পুড়িয়ে আরামে ঘুমাতে যেতো।
আমাদের অঞ্চলে সেসময় নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ইস্তারি পেতো (এখনো নিশ্চয়ই পায়)। বাপের বাড়ি থেকে যেতো তিন বার। প্রথম রোজার দিন বাধ্যতামূলক, তারপর মাঝখানে ১৫ রোজায় বড় ইফতারি, শেষ দিকে আরেকবার। আর মেয়ে পক্ষের অন্য আত্মীয়-স্বজনেরা অন্তত একবার হলেও মেয়ের বাড়ি ইফতারি পাঠাবেই। এই দেয়া-নেয়ার চল আত্মীয়দের মধ্যে মিল মহব্বত বাড়াতো, যোগাযোগের সেতু বন্ধন মজবুত করতো।
আমার মায়ের বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। এখনো তাঁর বাবার বাড়ি এবং মামার বাড়ি থেকে ইস্তার আসে। মায়ের মামাতো ভাইয়ের ছেলে যখন আমাদের বাড়ি ইস্তারি নিয়ে আসে, এটা হয় আমাদের বাড়িতে তাঁর বাৎসরিক একমাত্র ভ্রমণ। আমার মা ও হয়তো তাঁকে এই তরুণ বয়সে প্রথম দেখে অবাক হন। পরে তাঁর দাদার নাম শুনে বাড়তি খাতির শুরু করেন।
আমার দুই বোন। একটা বিয়ানী বাজারে থাকে, ও এখনো সকল আত্মীয় স্বজনের বাড়ি থেকে ইস্তারি পায়। আমার ছোট দুই ভাই বউ নিয়ে বিলাত থাকে। তাদের শাশুড়ি এক সময় আমার মাকে ইস্তারি খাওয়ার জন্য পাউন্ড পাঠাতেন। বিষয়টির যথার্থতা না থাকার কারণে আমি নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু আমার কথা কে শুনে ! এটা নাকি সিলেটের চল, ভাঙ্গা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে আমি প্রায়ই চুপ থাকি। বেশি কথা বলি না।
লেখক : Shakoor Majid
স্থপতি, নির্মাতা,
লেখক।