সুরসাগর প্রাণেশ দাশ বাংলা সংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর সুরের জাদু শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে গেছে যুগের পর যুগ। তিনি ১৯১৭ সালের ১৫ই নভেম্বর বাংলাদেশের সিলেটের এক সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রসন্ন দাশ ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক ও সংগীতানুরাগী, আর মাতা নিতম্বিনী দাশ ছিলেন তাঁর সংগীত শিক্ষার অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা।
মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি সংগীতগুরু শ্রী কুমুদরঞ্জন গোস্বামীর কাছে তালিম নিতে শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সংগীতের প্রতি তাঁর অসাধারণ প্রতিভার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হন। ১৯৩৯ সালে, মাত্র ২২ বছর বয়সে, কলকাতা বেতারে উচ্চাঙ্গসংগীত ও লঘু সংগীত পরিবেশন করে বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ান। শাস্ত্রীয় সংগীত জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্নেহধন্য শিষ্য হিসেবে তিনি সংগীতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন।
১৯৪১ সালে পুষ্পলতা দাশের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংগীতজীবনের পথচলাকে আরও দৃঢ় করেন। একই বছরে কলকাতার স্টার থিয়েটারে নাটকের সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পান, যা তাঁর প্রতিভার আরও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকশিক্ষা সংসদের সিলেট সংগীত বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হন।
দেশভাগের পর, কলকাতা বেতারের আমন্ত্রণ পেলেও তিনি জন্মভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে বাংলাদেশেই থেকে যান। ১৯৫২ সালে সিলেটে ‘গীতালি’ সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সংগীত শিক্ষা দিতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল, সিলেট (পরবর্তীতে একাডেমি অব ফাইন আর্টস)-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি সিলেট সরকারি অগ্রগামী বালিকা বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষা দিতেন।
একজন সফল শিল্পী, সুরকার, গীতিকার এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি সংগীত জগতে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন। তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁকে ‘সুরসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত তাঁর সংগীত সংকলন ‘গোধূলির বাঁশি’-তে স্বরলিপিসহ ২০টি গান সংকলিত হয়, যা প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুরসাগর হিমাংশু দত্তের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে আমিনুর রশিদ চৌধুরীর রচিত ২৬টি আধুনিক গানে সুরারোপ করে তিনি ‘গানের ডালি’ শিরোনামে প্রকাশ করেন।
সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত নির্মলেন্দু চৌধুরীর ‘তোমরা দেখো গো আসিয়া কমলায় নৃত্য করইন…’, আরতি ধরের ‘তুমি রহমতের নদীয়া, দয়া করো মোরে হজরত শাহজালাল আউলিয়া…’ বা আব্দুল আলিমের ‘হায় রে তোমার পিরিতের এত জ্বালা রে বন্ধু…’—এসব কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা ছিলেন তিনি। তাঁর সুর ও পরিচালনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, প্রভাতী শ্যাম, রাখী চক্রবর্তী, নির্মলেন্দু চৌধুরী, বিদিত লাল দাশ, আরতি ধর, সুজেয় শ্যাম, আকরামুল ইসলাম প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেছেন।
রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকসংগীত, এমনকি উচ্চাঙ্গসংগীত—সব ক্ষেত্রেই প্রাণেশ দাসের অনায়াস বিচরণ ছিল। সংগীতের প্রতিটি শাখাতেই ছিল তাঁর এক অনন্য নৈপুণ্য ও গভীরতা, যা শ্রোতাদের মনকে স্পর্শ করত। সুরের নির্মাণে তাঁর বিশেষজ্ঞতা ছিল অভূতপূর্ব । যন্ত্রসংগীতেও তিনি ছিলেন সমানভাবে দক্ষ, এবং তাঁর হাতে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে সুরের সৃষ্টি একটি অতুলনীয় অভিজ্ঞতা ছিল। তাঁর বাদ্যযন্ত্রের প্রতিভা ছিল এমন যে, তিনি বহু বাদ্যযন্ত্রে সমান পারদর্শী ছিলেন, যা তাঁর সংগীতকর্মকে আরও সমৃদ্ধ ও বহুস্তরীয় করে তুলেছিল।
প্রাণেশ দাসের গায়কী ছিল তাঁর শিল্পীসত্তার অন্যতম প্রধান দিক। তাঁর গানে ছিল এক বিশেষ আবেগ, যা শ্রোতাদের হৃদয়কে স্পর্শ করত। গানের সুরে তিনি এমন এক অনুপ্রেরণা ঢেলে দিতেন, যা শোনার পর শ্রোতারা যেন এক গভীর শান্তি ও প্রশান্তি অনুভব করতেন। তাঁর গায়কীর বিশেষত্ব ছিল তাঁর স্বরস্বাধীনতা, সুরের সঙ্গে তাঁর একতান এবং শব্দের মধ্যে বিশেষ অর্থের প্রবাহ। তাঁর গানে শাস্ত্রীয় এবং আধুনিকতার এক সুন্দর সমন্বয় ছিল, যা তাঁকে সর্বদা শ্রোতাদের মধ্যে জনপ্রিয় করে রেখেছিল। এমনকি, প্রাণেশ দাসের গান সময়ের বাধা পেরিয়ে আজও শ্রোতাদের মনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাঁর গাওয়া গানগুলো আজও আধুনিক শ্রোতাদের কাছে সমাদৃত এবং শ্রবণযোগ্য। তাঁর সুরের মাধুর্য এবং অসামান্য গায়কী তাঁকে এক অমর শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর গান কেবলমাত্র সংগীতের সীমানা অতিক্রম করেনি, মানবিক আবেগ, মনোবৈকল্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক নিখুঁত প্রকাশ হিসেবে জীবন্ত হয়ে আছে।
প্রজ্ঞা, প্রতিভা, এবং মানবিক গুণাবলির অপূর্ব সংমিশ্রণে সমৃদ্ধ এই মহান শিল্পী ১৯৬৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ভোরে মাত্র ৫২ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। তাঁর অবদান বাংলা সংগীতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁর কর্ম ও সৃষ্টির মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হবে—এই প্রত্যাশা চিরকাল বেঁচে থাকবে।
ঋণ স্বীকার:
১. সুরসাগর প্রাণেশ দাশের পৌত্রী নীতা রায়ের তাঁর মাহামহ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ, প্রকাশিত ২৭ আগস্ট ২০২০।
২. অনিমেষ বিজয় চৌধুরী : শিল্পীর ছবি।
তাঁদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
লেখক পরিচিতি
মিহিরকান্তি চৌধুরী
লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার সিলেট।
সিলেট বেলা / এস এস / ০৯