সাংস্কৃতিক মনন, প্রজ্ঞা ও মানবিক গুণাবলির এক উজ্জ্বল প্রতীক ছিলেন অ্যাডভোকেট সুপ্রিয় চক্রবর্তী রঞ্জু। তাঁর প্রয়াণ আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। তিনি শুধু পেশাগত জীবনে একজন খ্যাতিমান আয়কর আইনজীবী ছিলেন না, বরং সমাজ ও সংস্কৃতির অঙ্গনে এক নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনচার বছর হল চিরবিদায় নিয়েছেন। সমাজে একজন নৈর্বক্তিক ব্যক্তি হিসেবে বিশেষ মর্যাদা ছিল।
রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ, এবং তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, সিলেট শাখার অন্যতম কর্ণধার। তাঁরই সৌজন্যে তাঁর নিজ বাসভবনে এই সংগঠনের সাপ্তাহিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো, যা তাঁর সাংস্কৃতিক রুচি ও দায়বদ্ধতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। সুপ্রিয় চক্রবর্তী মৃত্যুর দিন পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ সিলেটের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
সুপ্রিয় চক্রবর্তী রঞ্জু ছিলেন এক সজ্জন ও আদর্শবান মানুষ। তাঁর নৈতিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা সমাজে তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছিল। নিরহংকার অথচ দৃঢ়চেতা এই মানুষটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে তাঁর প্রজ্ঞা ও নৈতিক অবস্থানের জন্য শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ক্রীড়াঙ্গনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি সিলেট ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট সম্পাদক ছিলেন। দক্ষ সংগঠক হিসেবে তিনি ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও সমাজসেবায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। সিলেট সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাবেক সভাপতির দায়িত্ব পালনকালী সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। পেশাগত নেতৃত্বও ছিল তাঁর। তিনি সিলেট কর আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন।
তাঁর পারিবারিক জীবনও ছিল সংস্কৃতিমনা ও সৃজনশীলতায় পরিপূর্ণ। তাঁর স্ত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল একজন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং নারী অধিকার ও মানবাধিকার কর্মী ও নেত্রী, যিনি ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের একমাত্র কন্যা সুদেষ্ণা, রবীন্দ্রসংগীতের এক বিশিষ্ট শিল্পী, যিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মানসম্পন্ন অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। সুপ্রিয় চক্রবর্তীর বড়ো বোন রাখী চক্রবর্তীও ছিলেন খ্যাতনামা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এবং শান্তিনিকেতনে সংগীতের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। শিল্পী রাখী চক্রবর্তীতে নিয়ে আমি বছর চারেক আগে েএকটি প্রবন্থ লিখেছিলাম।
ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে সুপ্রিয় চক্রবর্তী রঞ্জুদার এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমি শুধু তাঁর ঘনিষ্ঠজনই ছিলাম না, বরং তাঁর ট্যাক্স ক্লায়েন্টও ছিলাম। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং তাঁর নৈতিকতা ও আদর্শ আমার প্রতি সবসময়ই অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। তাঁর বলিষ্ঠ অথচ সংযত ব্যক্তিত্ব, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, এবং সাংস্কৃতিক জগতে অবদান তাঁকে সত্যিকারের এক সম্মানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।
সুপ্রিয় চক্রবর্তী রঞ্জুদা ছিলেন এক জীবন্ত প্রতিষ্ঠান। রুচিশীল মানুষ ছিলেন। রসবোধ প্রখর ছিল, যাকে কিনা বলে শার্প সেন্স অব উইট অ্যান্ড হিউমার। আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে তিনি ক্রীড়া, সংস্কৃতি, সমাজসেবা এবং রাজনীতির প্রথম সারির বহু ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সর্বত্রই ‘রঞ্জুদা’ নামটি এক শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
সুপ্রিয় চক্রবর্তী রঞ্জুদা আপাদমস্তক প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। জীবদ্দশায় তো ছিলেনই, মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যয়ন ও গবেষণার্থে যাতে দান করা হয় সেই ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। স্বস্তির বিষয়, পরিবার তাঁর আকাঙ্খার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। শুধু তাঁর পরিবারই নয়, বরং বৃহত্তর সমাজও তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করছে, করবে। এই মহৎ ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর আদর্শ, সততা ও মানবিকতা আমাদের জীবনের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।
লেখক পরিচিতি
মিহিরকান্তি চৌধুরী
লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার সিলেট।