দু’পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষে সিলেটে একদিনে (১ এপ্রিল) পৃথক চারটি ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে ৯ গ্রামের মানুষ। এতে প্রায় ২ শতাধিক লোক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গুরুতর আহত বেশ কয়েকজনের অবস্থা রয়েছে আশংকাজনক। সালিশ বৈঠক, কথা কাটাকাটি ও পূর্ব বিরোধের জের হিসেবে এইসব সংঘর্ষের ঘটনাগুলো ঘটে। এমন অবস্থাকে আগামীর অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন সমাজকর্মীরা। তাদের মতে, সামাজিক অবক্ষয়ের এক চরম প্রান্তে এসে পৌছেছে মানুষ। যেখানে পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকা, পারস্পরিক সহানুভূতির অভাববোধ এবং মূল্যবোধের অভাব থেকেই এই সমস্যা দিন দিন আর প্রকট আকার ধারণ করছে।
একদিনে মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) পৃথক চারটি ঘটনার মধ্যে দুটি সুনামগঞ্জে এবং বাকি দুটি হবিগঞ্জ জেলায় সংগঠিত হয়েছে। চার ঘটনায় সংঘর্ষে জড়ায় ৯ গ্রামের মানুষ। এর মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ৫২ জন ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় আরও ৮ জন ভর্তি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলায় দুটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে জগন্নাথপুর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলায়। এর মধ্যে জগন্নাথপুরে সংঘর্ষের ঘটনায় ৪০ এবং শান্তিগঞ্জে ২০ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জগন্নাথপুর উপজেলায় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে পূর্ব বিরোধের জের থেকে। মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) বিকেলে উপজেলার আশারকান্দি ইউনিয়নের দাওরাই ও জামালপুর গ্রামের মধ্যে এই ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সরকারি জায়গা নিয়ে গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী রাজ উদ্দিন ও একই গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা লেবু মিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। লেবু মিয়া সরকারি জায়গা দখল থাকলেও প্রবাসি রাজউদ্দিন মিয়া ওই জায়গা গোপনে লিজ আনেন। এ বিষয়ে নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। ওইসব বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিচার শালিশ করা হয়। সালিশ বৈঠক থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সংর্ঘষে দুই পক্ষের ৪০ আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে সাইফুল রহমান ইমানী (২৫) বাবুল মিয়া (৪২) আংগুর মিয়া (৬৫) আব্দুল আহাদ (৫৫) তাদের কে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অন্য আহতদের জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ওসমানীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জগন্নাথপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঞা বলেন, সরকারি জায়গা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ ছিল। সংঘর্ষের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, এখন ও মামলা হয়নি।
এদিকে জেলার শান্তিগঞ্জে ধান শুকানোর জায়গা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০ টায় উপজেলার শিমুলবাঁক ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামে এ সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে৷
স্থানীয় ও পুলিশ সুত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রঘুনাথপুর গ্রামে ধান শুকানোর জায়গা দখল ও পুর্ব বিরোধের জেরে দু’পক্ষের মধ্যে কথা-কাটা হয়। কথা-কাটাকাটি একপর্যায়ে দুইপক্ষ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। আহতরা সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে শান্তিগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আকরাম আলী বলেন, ধান শুকানোর জায়গা দখল নিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
এদিকে একইদিনে হবিগঞ্জে দুই স্থানে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। এই দুই ঘটনায় প্রায় ১৭০ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে হবিগঞ্জের বাহুবলের ঘটনায় তিন গ্রাম এবং লাখাইয়ের ঘটনায় দুই গ্রামের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া নারীকে উত্ত্যক্ত করার জেরে সংঘর্ষের সূচনা ঘটে। এ ঘটনায় মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উপজেলার বানিয়াগাঁও, চরগাঁও ও জয়নগর গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। রাতে টর্চলাইট জ্বালিয়ে তিন গ্রামের মানুষের সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২০ জন মানুষ।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার বিকেলে স্বামীর সঙ্গে চা বাগানে ঘুরতে যান বানিয়াগাঁও গ্রামের এক নারী। তাকে উত্ত্যক্ত করেন চরগাঁও গ্রামের তিন যুবক। এ সময় ওই নারীর স্বামী প্রতিবাদ করলে দুপক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
পরে দুই গ্রামে বিরোধ ছড়িয়ে পড়লে উভয় গ্রামের লোকজন মিরপুর বাজারে টর্চলাইট জ্বালিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পরে পাশের গ্রাম জয়পুরের গ্রামবাসী বানিয়াগাঁওয়ের পক্ষ নিয়ে সংঘর্ষে অংশ নেয়। একে অন্যের ওপর দেশীয় অস্ত্র ও ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে শতাধিক লোক আহত হয়। পরে রাত ৮টায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সংঘর্ষ চলাকালে মিরপুর বাজার এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। সংঘর্ষে আহতদের বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
নবীগঞ্জ ও বাহুবলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) জহুরুল হক বলেন, ‘স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া এক নারীকে উত্ত্যক্ত করা নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে একই দিনে অপর ঘটনা ঘটে হবিগঞ্জের লাখাইয়ে সালিশ বৈঠক চলাকালে। এ ঘটনায় দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষে অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে উপজেলার পূর্ব তেঘরিয়া দর্জি হাটিতে এ ঘটনাটি ঘটে।
পুলিশ ও স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, লাখাই উপজেলার পূর্ব তেঘরিয়া দর্জি হাটি এলাকার মজিদ মিয়া, ইকবাল মিয়া, হিরো মিয়া, কামাল মিয়া ব্যবসার কারণে ঢাকার মিরপুর এলাকায় বসবাস করেন। কয়েকদিন আগে সেখানে তুচ্ছ একটি বিষয় নিয়ে মজিদের সঙ্গে হিরো ও কামালের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ঈদের ছুটিতে এলাকায় ফিরে আসার পর মঙ্গলবার সকালে ওই এলাকার মজিদ মিয়া, ইকবাল মিয়া ও হিরো মিয়া, কামাল মিয়ার পক্ষের লোকজনকে নিয়ে সালিশি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। তবে বৈঠক চলাকালে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেধে যায়।
সংঘর্ষে লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এতে দুই পক্ষের অন্তত ৪০ জন আহত হন। গুরুতর আহতদের দ্রুত উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সংঘর্ষের খবর পেয়ে লাখাই থানার পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
লাখাই থানার ওসি বন্দে আলী জানান, সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে বর্তমানে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সিলেটের সাবেক আহবায়ক মুকির হোসেন চৌধুরী বলেন, পরমত সহ্য করতে না পারা এক ধরণের ব্যাধি। এই ব্যাধির ধীরে ধীরে বিস্তৃতি ঘটছে। এর প্রভাব আগামীর প্রজন্মকে আরও একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করে তোলবে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এই ব্যাধি শুরু হয় পরিবার থেকে। সুতরাং পারিবারিক শিক্ষাটাই প্রধান হিসেবে এখানে কাজ করে। আবার সামাজিক অস্থিরতার স্রোতও একইভাবে ধাবিত করে। অতএব পরিবার থেকে সমাজ,সর্বত্র ন্যায় বিচারের সুপ্রভাব, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং শৃঙ্খলাবোধ সবাইকে এই ব্যাধি থেকে থেকে রক্ষা করতে পারে।