সিলেটে পাথর কোয়ারি রয়েছে চারটি। কোয়ারিগুলোর নাম যথাক্রমে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি,সিলেটের জাফলং পাথর কোয়ারি,কানাইঘাটের লোভাছড়া কোয়ারি এবং বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি। এছাড়াও ভোলাগঞ্জে পাথর বেষ্টিত একটি টিলা রয়েছে। যার নাম শারফিন টিলা সেই টিলায় একজন ওলীর মাজার রয়েছে। টিলার উপরের পাথরগুলো এই টিলার রক্ষাকবচ হলেও সেটিও এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তাছাড়া কোয়ারিগুলোতে চলছে একের পর এক পাথর লুটের মহোৎসব। এই মহোৎসবের সারথী হিসেবে নাম এসেছে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের। লুটপাটের ঘটনায় আগে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নাম জড়িত ছিল। ২০১৪ সালে অবৈধ পাথর লুটে অন্তত ৫০ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর প্রশাসন সক্রিয় হলে বন্ধ করে দেয়া হয় পাথর উত্তোলন। শ্রমিক মৃত্যুর মিছিল কমে আসে। উচ্চ আদালতে বেলার রিটের কারণে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের শেষ দশ বছরে সিলেটের কোয়ারি লুটপাট থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু ৫ আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর আইনের প্রতি বৃদ্বাঙ্গুলি দেখিয়ে ফের শুরু হয় পাথর লুটের মহোৎসব। আর সেই স্থান এখন দখল নিয়েছে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো। ফলে সিলেটের তিনটি পাথর কোয়ারিই আজ হুমকীর সম্মুখীন। একের পর এক বোমা মেশিনের তান্ডবে তিন তিনটি কোয়ারি এখন ছিন্নভিন্ন। আর পাথর লুটের ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়েছে। তবে মামলার পরও থেমে থাকেনি পাথরলুটের মহোৎসব। অভিযান চললেও তাতে পাত্তা দিচ্ছেনা পাথরখেকো চক্র। তিনটি কোয়ারিতে গেল ৭ মাসে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে বলে কোয়ারিসুত্রে জানাগেছে। কোয়ারিগুলো রক্ষায় শতাধিক পাথরখেকোর নাম উল্লেখ করে ৩০ থেকে ৩৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে সকলেই আগের মতো রাজনৈতিক প্রভাবেই ধরাছোঁয়ার বাইরে।এর মধ্যে শুধুমাত্র জাফলংয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন যৌথ টাস্কফোর্সের অভিযান চালানো হয়েছে। ২ শতাধিক পাথরখেকোর নাম উল্লেখ করে ৮টি মামলা দায়ের করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
সিলেটের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি
দেশের বৃহত্তম পাথর কোয়ারি সিলেটের ভোলাগঞ্জ। ৫ আগষ্টের পূর্বে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি অরক্ষিত থাকলেও দৃশ্যপট পাল্টে যায় পট পরিবর্তনের পর। ৫ আগষ্টের পরের দিন থেকে এই কোয়ারিতে অবাধে লুট করা হচ্ছে। ভোলাগঞ্জে রয়েছে রেলওয়ের রূপওয়ের বাংকার। এই বাংকার পাহারায় ছিল রেলওয়ে নিরাপত্তাকর্মীরা। প্রথমেই তাদের ওপর হামলা চালানো হলে তারা সরে যায়। এরপর থেকে চলে লুটপাট। এই লুটের নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় যুবদল নেতা রজন আহমদ, রুবেল আহমদ বাহার ও জেলা যুবদল নেতা মোস্তাকিম ফরহাদ। তাদের নেতৃত্বে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, ব্যবসায়ীদের যৌথ সিন্ডিকেট। এই কোয়ারিতে গেল ৭ মাসে সাদাপাথর, বাংকারসহ গোটা কোয়ারি লুট করেছে। গেল ৭ মাসে ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। আর এই লুটে বিজিবি ও পুলিশের স্থানীয় সদস্য জড়িত ছিল। তারা প্রকাশ্যেই উত্তোলিত পাথর থেকে চাঁদাবাজি করছে-এমনটিও অভিযোগ রয়েছে।
ভোলাগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলা
ভোলাগঞ্জের অদূরে অবস্থিত একটি টিলা। যার নাম শাহ আরেফিন টিলা। এই টিলাকে এবার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এই টিলা থেকে উত্তোলিত পাথরে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে বিতর্কিত হন কোম্পানীগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর সহ ১৩ পুলিশ সদস্য। এ ঘটনায় তাদের কোম্পানীগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও মূলত পুলিশের শেল্টারেই শারপিন টিলায় অবাধে লুট করা হচ্ছে পাথর। এই টিলা থেকে অন্তত ২০০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। তবে মূলত পুলিশের শেল্টারেই এখনও শারপিন টিলায় অবাধে লুট করা হচ্ছে পাথর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, পুলিশ উপজেলা প্রশাসন ও পাথর খেকোরা মিলে সিন্ডিকেট তৈরী করে শাহ আরেফিন মাজারসহ মসজিদ ও মাদ্রাসার মাটি খুড়ে শেষ করে দিয়েছে। সরকার এটা বন্দোবস্ত দিলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পেত। অন্যদিকে হাজার হাজার মানুষ বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ পেত। সরকারীভাবে বন্দোবস্ত কিংবা লিজ না দেয়ায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শাহআরেফিন টিলাসহ আশপাশের খনিজ সম্পদ লুট করা হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জের পাথরখেকো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে আইয়ুব আলী, রফিক মিয়া, মনির মিয়া, আব্দুল করিম, আব্দুর রশিদ সহ প্রায় ৪০/৫০ জনের নেতৃত্বে হাজার হাজার শ্রমিক ড্রেজার ও ভেকু মেশিন লাগিয়ে গভীর গর্তের নীচ থেকে পাথর উত্তোলন করছেন। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি পরিবেশ আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তারা হলেন,কাঠালবাড়ী গ্রামের জিয়াদ আলী পুত্র পাথর খেকো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (৪৫), জালিয়ার পাড় গ্রামের মৃত রহিম উল্লার পুত্র মনির মিয়া (৪৫) একই গ্রামের মৃত নঈম উল্লাহর পুত্র আব্দুল করিম (৫০), আব্দুর রশীদ (৫৫), চিকাডহর গ্রামের মৃত মনফর আলীর পুত্র আইয়ুব আলী (৫৫), আঞ্জু মিয়া (৫০), সোহরাব আলী (৩৯), তৈয়াব আলী (৪৫), বতুল্লাহ মিয়া (৪০), মৃত ইউনুস আলীর পুত্র আব্দুল হান্নান (৪০), আনোয়ার আলী (৫৫), একই গ্রামের মৃত উস্তার আলী পুত্র আনফর আলী (৫৫) মৃত রফিক উল্লাহর পুত্র গরীব উল্লাহ (৫৮), জালিয়ারপাড় গ্রামের মৃত আব্দুল গণির পুত্র মোঃ ইব্রাহিম (৪০),সহ আরো প্রায় ৪০ জন।
এদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০ এর ধারা—৫ মোতাবেক মামলা দেয়া হয়েছে। মামলা দিলেও স্থানীয় পুলিশ কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কোন তৎপরতা দেখা যায়নি।
সিলেটের জাফলং পাথর কোয়ারি
সিলেটের জাফলংকে বলা হয় পাথর রাজ্য। ৫ই আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত জাফলংয়ে পাথর লুট চলছে। প্রথম দিকে মাটির উপরে থাকা পাথর লুট করা হয়। গত দু’মাস ধরে চলছে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর লুট। কয়েকশ’ বোমা মেশিন প্রতিদিন জাফলংয়ের ভূগর্ভ থেকে পাথর লুট করছে। বোমা মেশিনের তাণ্ডবে জাফলং এখন ছিন্নভিন্ন। আগস্টে মাত্র ১০ দিন লুটের পরিসংখ্যান জানিয়েছিল উপজেলা প্রশাসন। তারা বলেছিল এই ১০-১২ দিনে ১২৫ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এই লুটেই থেমে থাকেনি পাথরখোকারা। এরপর থেকে তারা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে লুট করেই চলেছে। স্থানীয়দের মতে- গত ৭ মাসে জাফলং থেকে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এই পাথর লুটের নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা বিএনপি’র পদ স্থগিত হওয়া নেতা রফিকুল ইসলাম শাহ্পরাণ ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন। তাদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় পাথরখেকো চক্র এই কোয়ারিতে লুটপাট চালাচ্ছে। সম্প্রতি এসে এতে যোগ দিয়েছেন যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা।
এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বেই জাফলংয়ের বল্লাপুঞ্জি, মন্দির’র জুমপাড়,জিরোপয়েন্ট,বাবুল’র জুম এলাকা, বল্লাপুঞ্জি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর জাফলং সেতু সংলগ্ন পাথর কোয়ারী এলাকায় অবৈধ ভাবে দানবযন্ত্র ফেলুডার মেশিন দিয়ে মাটি কেটে পাথর উত্তোলনের চলছে মহোৎসব। তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও প্রশাসন নির্বিকার। বরং তাদের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন বিএনপিপন্থি কিছু আইনজীবী। মামলা চালানের মাধ্যেম বহিস্কৃত নেতাদের কাছ থেকে আর্থিক ভাবে লাভবান হয়ে, বিভিন্ন ভাবে আশ্রয় প্রশয় দিয়ে বাচিয়ে রাখছেন প্রশাসনের ধরপাকড় থেকে। অথচ তাদের অবৈধ কর্মযজ্ঞে ফেলুডার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে জুমপাড় এলাকায় শ্রী শ্রী বালিবাড়ি মন্দির,বল্লাঘাটের পুরাতন পর্যটন স্পট, বল্লাপুঞ্জি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, শত হেক্টর ফসলী জমি, চা বাগান,জাফলং সেতু,জাফলং বাজার,নয়াবস্তি,কান্দুবস্তী গ্রামের বসতবাড়ি ও খাসিয়া সম্পাদায়ের,পান সুপারীর বাগানসহ আশ পাশের এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। আশঙ্কা রয়েছে।
কানাইঘাটের লোভাছড়া কোয়ারি
কানাইঘাটের লোভাছড়ায় জমা ছিল উত্তোলিত পাথর। কিন্তু ৫ই আগষ্টের পর আর সেই পাথর গুলো আর রক্ষা করা যায়নি। শেখ হাসিনা সরকারের শেষদিকে লোভাছড়া কোয়ারি ইজারা দেয়া হলেও উত্তোলিত পাথর সরিয়ে নিতে পারেনি পাথরখেকোরা। পাথর লুট বন্ধ হওয়ায় সিলেটের কোয়ারিগুলোতে যৌবন ফিরে এসেছিল। কিন্তু তারপর শুরু হয় হয় লুটপাট কাণ্ড। লিজ না নিয়েই তিনটি পাথর কোয়ারি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই চলছে পাথর লুট।
বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি
দেশের অন্যতম বড় পাথর কোয়ারি বিছনাকান্দি এখন পাথরশূন্য। দুই মাসে বিছনাকান্দি কোয়ারির উপরের অংশে থাকা অন্তত ৩০০ কোটি টাকার পাথর লোপাট করা হয়েছে। এই কোয়ারির লুটের পাথর জব্দ করতে গিয়ে গোয়াইনঘাটের পুলিশও বিতর্কিত হয়। পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন- যেভাবে সিন্ডিকেট করে পাথর লুট করা হচ্ছে সেটি পুলিশ দিয়ে দমানো সম্ভব নয়। আর পুলিশ, বিজিবি ও পাথরখেকো সিন্ডিকেট এক হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন যৌথ অভিযান। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেভাবে চোরাই রাজ্য হরিপুরকে ধ্বংস করেছে সেভাবে যৌথবাহিনীর সদস্যরা জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছনাকান্দিতে নামলে পাথর লুট বন্ধ করা সম্ভব হবে। জাফলং থেকে ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন অবস্থিত। পাথর লুট বন্ধ না হলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা আরও তীব্র হবে বলে জানান তারা।
সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল ইসলাম জানান, জাফলংয়ে পাথর লুট বন্ধ রাখতে ইতিমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ২০ থেকে ২৫ দিন অভিযান চালানো হয়েছে। তিনি জানান, অভিযান, মামলা সবই হচ্ছে। সিলেটের এসপিকে আসামিদের তালিকা দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এ নিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়া যায় কি না এ ব্যাপারে কাজ করা হচ্ছে।
দেশের বৃহত্তর কোয়ারি জাফলংয়ে ইসিএ-ভুক্তকরণ, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি ও লোভাছড়ায় লুট বন্ধে আইনি লড়াইয়ে নামে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা। এরপর পরই বন্ধ করে দেয়া হয় পাথর উত্তোলন। শ্রমিক মৃত্যুর মিছিল কমে আসে। উচ্চ আদালতে বেলার রিটের কারণে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের শেষ দশ বছরে সিলেটের কোয়ারি লুটপাট থেকে রক্ষা পায়।