1. admin@sylhetbela24.com : admin :
June 22, 2025, 1:45 am
বিজ্ঞপ্তিঃ
সিলেট বেলা ২৪ ডটকম এর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম! আপনার আশে পাশের ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ আমাদেরকে জানাতে sylhetbela247@gmail.com এ পাঠিয়ে দিন। আমরা যাচাই বাছাই শেষে তা যথারীতি প্রকাশ করবো। আপনার প্রতিষ্ঠানের বিশ্বব্যাপী প্রচারের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

গল্প নয়, জীবনকাহিনি

  • প্রকাশিতঃ মঙ্গলবার, এপ্রিল ৮, ২০২৫
  • 47 বার সংবাদটি পড়া হয়েছে

পুরনো দিনের একটা গানের কথা মনে আছে আপনাদের? সেই যে – ‘গান নয় জীবনকাহিনি, সুর নয় ব্যথার রাগিনী’, রুনা লায়লা গেয়েছিলেন তাঁর অপূর্ব দরদি কণ্ঠে, সেটির কথা বলছি। গানটা বন্দিনী সিনেমার, লিপসিং করেছিলেন ববিতা, অনিন্দ্যসুন্দর তরুণী ববিতা। জানেনই তো, তিনি এমন এক নায়িকা, জীবনানন্দের ভাষায় যাকে বলা যায় – ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে পায় নাকো আর!’ আমার কৈশোর এবং তারুণ্যে আমি তাঁর জন্য গভীর প্রেম অনুভব করতাম। মনে হতো – এত লাবণ্যময়ী, এত সুন্দর, এত মিষ্টি নায়িকা পৃথিবীতে আর কখনো আসেনি, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও আসবে না! মনে হতো, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে দেখার জন্য দুটো চোখ দিয়েছেন আর ববিতাকে এই মর্ত্যরে নায়িকা হিসেবে পাঠিয়েছেন। অবশ্য আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তিনি মর্ত্যরেই কি না! তো, গানটিতে ঠোঁট মেলানোর সময় তিনি এত বিষণ্ন ছিলেন, এত গভীর বিষণ্ন, এত গভীর সুন্দর বিষণ্ন, যে, চোখ থেকে কখনোই সেই মুখটি মুছে ফেলতে পারিনি। (আবার ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপিচুপি বলে যায়’ গানে লিপসিংয়ের সময় তাঁর লাস্যময়ী, লাজুক রূপটিও নিশ্চয়ই ভোলেননি!) আপনারা যাঁরা ছবিটি দেখেছেন বা ইউটিউবে গানটি দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আমার কথা মানবেন। ওই গানের দৃশ্যে যে-নায়কটি গিটার বাজাচ্ছিলেন, তাঁর নাম ওয়াহিদ। কোনো পেশাদার অভিনেতা ছিলেন না তিনি, ঢাকাস্থ আফগান রাষ্ট্রদূতের পুত্রকে চরিত্রের প্রয়োজনে নির্বাচন করেছিলেন পরিচালক। ওই একটি ছবিতেই অভিনয় করেছিলেন তিনি, কিন্তু সেটি দেখার সুযোগ পাননি। বন্দিনী মুক্তি পাওয়ার আগেই পিতার বদলিসূত্রে তিনিও বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। এসব অনেক আগের কথা। গত শতকের সত্তর দশকের মাঝামাঝি নির্মিত হয়েছিল ছবিটি। এর প্রায় আড়াই যুগ পর সেই ওয়াহিদ হঠাৎ একদিন ববিতাকে ফোন করেন। জানান যে, বহু কষ্টে ববিতার নম্বর জোগাড় করেছেন। ছবিটি তিনি দেখেননি, ববিতাকে অনুরোধ করেন একটা প্রিন্ট তাঁকে পাঠাতে। ওয়াহিদ তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। ববিতা সত্যিই আড়াই যুগ আগের সেই ছবির একটা ডিভিডি জোগাড় করেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিয়েও যান; কিন্তু সেটি আর ওয়াহিদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ পাননি।

এই যে দেখুন, একটা গানের কথা বলতে গিয়ে আমি আপনাদের সঙ্গে আরেক গল্প জুড়ে দিয়েছি এবং আপনারা গল্প শোনার ঝোঁকে তা পড়েও ফেলেছেন। কিন্তু ওয়াহিদ-ববিতার গল্প তো আমি বলতে বসিনি, বসেছি নিজের গল্প বলবো বলে; আজকে আমি কথক, আপনারা শ্রোতা। আপনাদের আগ্রহ থাকলে ওয়াহিদের গল্প নিজেরা খুঁজে পড়ে নিন। তো, নিজের গল্প বলতে গিয়ে ওই গানের কথা মনে পড়লো – ‘গান নয়, জীবনকাহিনি’, আমারটাও গল্প নয়, জীবনকাহিনি। কিন্তু গল্পই বলি আর জীবনকাহিনিই বলি, আমার জীবনের গল্প আসলে বেশি বড় নয়। দু-লাইনেই সেরে ফেলা যায়। কিন্তু অত অল্প কথায় গল্প বললে তো আপনারা শুনবেন না। আবার বেশি কথা বলতেও ইচ্ছে করে না।

সত্যি বলতে কী, আমার এখন কথাই বলতে ভালো লাগে না। কারো সঙ্গেই না। মা-বাবা-ভাই-বোনের সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকে কথা বলে চলেছি, অফুরন্ত কথা, কিন্তু এখন চুপ করে থাকতে ভালো লাগছে, যেন কেবল শ্রোতা আমি, বলার মতো কিছু নেই। অবশ্য বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন অনেক আগে, তবে ভাইবোনের সঙ্গে কথা বলতাম। বন্ধুবান্ধব কিংবা সহকর্মীদের সঙ্গেও আজকাল আর কথা বলি না, মানে যতটা না বলে থাকা সম্ভব তাই থাকি। এমনকি প্রিয় কোনো বন্ধু বা প্রেমিকা, যাদের সঙ্গে কথা বললে মনের ভার কমবে বলে মনে হয়, তাদের সঙ্গেও আর কথা হয় না – অবশ্য আমার কোনো প্রেমিকা নেই, সম্ভবত বন্ধুও নেই!

কথা বলি না কেন জানেন? কারণ, যখনই কথা বলতে যাই, দেখি, কথা হয়ে উঠেছে কথোপকথন, মানে সংলাপ, দুই পক্ষই একইসঙ্গে কথক এবং শ্রোতা। এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? একজন একতরফাভাবে কেবল বলেই যাবে আর অন্যজন কেবল শুনেই যাবে, তা তো হয় না। অবশ্য হতেও পারে, যদি একজন মূক হয়, অথবা অন্যজন হয় বধির। কিন্তু সেটা তো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়, এরকম জুটি পৃথিবীতে ক’টাই বা পাবেন? স্বাভাবিক হলো দুজনেই কথা বলা এবং শোনা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে কথক-শ্রোতার এই ভূমিকা সমবণ্টিত নয়। কেউ একটু বেশি বলে আর কাউকে একটু বেশি শুনতে হয়। অনেক দেখেছি, মানুষ শ্রোতা হওয়ার চেয়ে কথক হওয়াতেই বেশি আনন্দ পায়। সবাই বলতে চায়, শুনতে নয়। কথোপকথনের সমস্যা হলো, কথার অভিমুখ ঘুরে যাওয়া। ধরুন, আপনি একটা কথা শুরু করলেন, কিন্তু অপরপক্ষ তো কেবল শ্রোতা হয়েই থাকবে না, কথার পিঠে কথা বলবে, কিংবা নিদেনপক্ষে দু-একটা মন্তব্য বা প্রশ্ন করবে। আপনি তখন তার প্রতিউত্তরে কিছু বলতে শুরু করলেই ফাঁদে পড়বেন, দেখবেন কথার পিঠে আরো কথা আসছে, আসছে মন্তব্য বা প্রশ্ন, এবং আপনি আরো বেশি জড়িয়ে পড়ছেন, যে-কথা বলতে শুরু করেছিলেন তা হয়তো হারিয়েই গেছে কিংবা না হারালেও সেখান থেকে অনেক দূরে সরে এসেছেন। তার মানে দাঁড়ালো, কথোপকথন এক ধরনের ফাঁদ। কথা হারানোর ফাঁদ। কথা বলতে গিয়ে তা যদি হারিয়েই যায়, তাহলে আর বলে কী লাভ?

একসময় মনে হলো, এত বলে কী হয়? বরং চুপ থাকা যাক। কিন্তু ঠোঁট বন্ধ করলেই যে মন বন্ধ হবে, তা তো নয়। মন তো কথা বলেই চলে। আমি তখন কী করি জানেন? কথা বলি, তবে সামনে কেউ থাকে না, এমনকি ফোনের অন্য প্রান্তেও কেউ থাকে না, অথচ কারো না কারো সঙ্গে কথা বলি, প্রিয় কোনো বন্ধু বা প্রেমিকার সঙ্গে – ও আচ্ছা, একবার তো বলেছি আমার বন্ধু বা প্রেমিকা নেই, না থাকলেই কি, মনে মনে কথা তো বলাই যায়। এমনকি হারিয়ে যাওয়া কোনো শুভাকাক্সক্ষী কিংবা মৃত কোনো স্বজনের সঙ্গেও বলা যায়। কথোপকথনের দায় যেহেতু নেই, তাই নেই কাউকে সেসব কথা শোনানোর দায় কিংবা তার কথা শোনার দায়। সবচেয়ে ভালো হলো, মৃত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা। ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসবে না, আসবে না কোনো প্রতিক্রিয়াও, একতরফাভাবে কেবল বলে যাওয়া যাবে। আপনার মনে হতেই পারে, মনে মনে কথা বললে মৃত মানুষই কী আর জীবিত মানুষই বা কী? কেউই তো পাল্টা কথা বলবে না। না, আপনার ধারণা ঠিক নয়। একজন জীবিত মানুষের সঙ্গে মনে মনে কথা বলে দেখুন, ধরা যাক তিনি আপনার কাছ থেকে অনেক দূরে আছেন, হয়তো বহুকাল দেখাও হয় না, তবু কথা শুরু করলে দেখবেন আপনার মনের ভেতর থেকে সেও কথা বলে উঠেছে। অর্থাৎ কথোপকথন শুরু হয়ে গেছে, একতরফা বলে যেতে পারছেন না। সেজন্যই মৃতদের সঙ্গে কথা বলা সুবিধাজনক। আমি তাই বলি। সবচেয়ে বেশি বলি মায়ের সঙ্গে।

এবার একটা সত্যি কথা বলি। আমার আসলে কথা বলার মানুষই নেই। মা-বাবার মৃত্যুর পর ভাইবোনদের নিয়ে ছিলাম, তারা যার যার মতো নিজের জীবনে থিতু হয়েছে, এক এক করে ছেড়ে গেছে আমাকে। বিয়ে করিনি বলে আমার কোনো সংসারও নেই। ওই যে বলছিলাম, আমার গল্প দু-লাইনেই শেষ করে দেওয়া যায়। কেন জানেন? গল্প আসলে এটুকুই : আমি তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বেরিয়েছি, আকস্মিকভাবে বাবা মারা গেলেন। বড় ছেলে হিসেবে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো আমার কাঁধে। পাঁচটি ছোট ভাইবোন ছিল আমার। ওরা সবাই তখন পড়াশোনা করছে। এত বড় সংসার চালানোর জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে লাগলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতে মাও চলে গেলেন পরপারে। যাওয়ার সময় আবার বলে গেলেন, ‘ওদেরকে তুই ফেলে দিস না, দেখে রাখিস।’ ফেলে দেব কেন? ওরা আমার ভাইবোন না? ওদেরকে নিয়েই আমার সময় কাটতে লাগলো। ওরা পড়াশোনা শেষ করলো, চাকরিবাকরি পেল, বোনদের বিয়ে হয়ে গেল, ভাই দুটো পড়লো বিপদে। আমি বিয়ে করিনি, ওরা করবে কীভাবে? কিন্তু আমিই ওদের ফ্রি করে দিলাম, বললাম, পছন্দের কেউ থাকলে বল, বিয়ের ব্যবস্থা করি। দুজনেই বিয়ে করল বছরদুয়েকের ব্যবধানে। কিন্তু একসঙ্গে রইলো না ওরা। আলাদা বাসা নিল। এখন ওদের সবারই ছেলেমেয়ে হয়েছে, যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত, সুখের সংসার। ওরা যদি আমার কাছে থাকতো, তাহলে ওই পিচ্চিপাচ্চাদের নিয়েই আমার সময় বেশ কেটে যেত। বয়স হয়েছে, বেলা পড়ে এসেছে, শিশুদের সঙ্গই সবচেয়ে ভালো লাগার কথা এখন। কিন্তু আমার ভাগ্যে নেই …

আপনাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে, কেন আমি বিয়ে করলাম না! কোনো কারণ নেই আসলে। সংসার সামলাতে গিয়ে এত হিমশিম খাচ্ছিলাম যে, বিয়ের কথা মনেই ছিল না। যখন একটু সামলে উঠলাম, ততদিনে আমার মাথার ওপর কেউ নেই। মা থাকলে হয়তো দেখেশুনে বিয়ে করাতো, কেউ খেয়াল করেনি, আমিও খুব বেশি ভাবিনি, দেখতে দেখতে বয়স বেড়ে গেছে। কী বললেন? পছন্দের কেউ ছিল কি না? থাকলেইবা কী? আমি কাউকে পছন্দ করলেই সেও আমাকে পছন্দ করবে, এরকম কোনো কথা তো নেই, না? কথা ঘোরাচ্ছি? তাই মনে হচ্ছে আপনাদের? আসলে এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া একটু কঠিন। কেন কঠিন বলছি।

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম, কিন্তু কখনো তাকে বলতে পারিনি। আমার তিন বছরের জুনিয়র ছিল মেয়েটা, তবু পারিনি। খুবই সাধারণ ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে, অহরহই এমন ঘটে, তাই না? কিন্তু ওটা কোনো সাধারণ ব্যাপার ছিল না। মেয়েটা ছিল দুর্ধর্ষ রূপসী, মানে ওরকম সুন্দর মেয়ে বাস্তবে দেখা যায় না। প্রতিদিন শাড়ি পরে আসতো সে, তাতে রূপ আরো ঝলমল করে উঠতো। শাড়ি পরলেই সবাইকে যে সুন্দর লাগবে এমন কোনো কথা নেই, অনেকে তো জানেই না কীভাবে পরতে হয়, দেখে মনে হয় – কম্বল জড়িয়ে রেখেছে গায়ে। কিন্তু ও পরতো ববিতার মতো করে। হ্যাঁ, ববিতা তখনো আমার কাছে সৌন্দর্যের প্রতীকচিহ্ন হয়ে ছিলেন। যা হোক, সে পড়তো ছোট একটা ডিপার্টমেন্টে, তার পাশেই আমাদের বড়, অভিজাত এবং প্রভাবশালী ডিপার্টমেন্ট, গোপনীয়তার স্বার্থে নাম উল্লেখ করছি না। তার পরিচয় অবশ্য কেবল কোন ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী তাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তাকে দেখতে সারা ক্যাম্পাসের ছেলেরা আসতো, তার রূপের খ্যাতি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল। সে কেবল নিজের ডিপার্টমেন্টে বসেও থাকতো না, ঘুরে বেড়াতো পুরো ক্যাম্পাসে, আশেপাশেও। যেখানেই যেত সে, যেন আলোকিত হয়ে উঠতো জায়গাটা। নানারকম ডাকনাম দিয়েছিল ছেলেরা। যেমন, করাত – দাগ বসিয়ে কেটে ফেলে, কিংবা ড্যাগার – দুদিকেই কাটে, হৃদয়ও ক্ষতবিক্ষত হয়, মস্তিষ্কও ইত্যাদি। এরকম সুন্দর মেয়েকে কেবল তার রূপের জন্যই পছন্দ করা যায় এবং সে সকলের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে বলে পছন্দের কথাটা তাকে বলে ওঠা যায় না, বলার সাহস হয় না আর কি! এ পর্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক ঘটনাটা ঘটেছিল পরে।

আমি তখন পাশ করে বেরিয়ে এসেছি, একটা চাকরিতেও ঢুকেছি। বাবা তখনো মারা যাননি, সংসারের ভারও আমার কাঁধে এসে চাপেনি। ক্যাম্পাস ছেড়ে এলেও মায়া ছাড়তে পারিনি বলে অফিস শেষে প্রায়ই যেতাম, বেকার বন্ধুরাও যেত, অলস আড্ডা দিতাম। সেরকমই একদিন ফার্স্ট ইয়ারের কয়েকজন জুনিয়র মেয়ে এসে বললো, প্রভা আপু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

আমি অবাক হলাম। এতগুলো বছর ধরে কথা বলতে চাইলো না, এখন কেন? আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম, কী বিষয়, ওরা কিছু জানে কি না।

ওরা হেসে গড়িয়ে পড়লো, ওই বয়সী মেয়েরা যেমন কথায় কথায় হাসে সেরকম, বললো – জানি তো ভাইয়া।

বলো।

আপু আপনাকে প্রপোজ করবে। ইনফ্যাক্ট আমাদেরই বলেছে, আমরা যেন উনার হয়ে আপনাকে কথাটা বলি। আমরা বলেছি, পারবো না, আপনিই বলেন। সেজন্য আমাদের পাঠিয়েছে।

অ! তোমাদের পাঠালো কেন? ওকেই আসতে বলো না!

দরকার নেই ভাইয়া। মেয়েটাকে তো চেনেন। সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়, আপনাকেও ঘোরাবে।

না বললেও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, যে-মেয়ে সব ছেলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে তাকে অন্য মেয়েরা ঈর্ষা করবেই। সংগত কারণেই আমি ওদের কথা না শুনে সত্যিই ওর সঙ্গে দেখা করলাম। আর ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে। বললো, অনেক আগে থেকেই সে আমাকে লক্ষ করে, আমার ‘সব’ নাকি সে জানে। বলা বাহুল্য, সব সে জানতো না, সত্যি বলতে কি, প্রায় কিছুই জানতো না। তবে হ্যাঁ, প্রথমদিনের আলাপেই সীমাবদ্ধ ছিল না, আরো বেশ কয়েকদিন আমরা দেখা করেছি, কথা বলেছি, দুজনই দুজনের সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে নিয়েছি, পরস্পরের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছি, এমনকি একদিন বিয়ে নিয়েও আলাপ হয়েছিল। কথাটা সে-ই তুলেছিল। আমি তখনো অতদূর পর্যন্ত ভাবিনি বলে সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। সেও আপত্তি করেনি। কিন্তু সেই সময় আর শেষ হলো না। বাবার আকস্মিক মৃত্যু আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। শুধু যে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তাই নয়, আমার চিন্তার ধরনও পাল্টে গেল। আড্ডার জন্য ক্যাম্পাসে যাওয়া হতো না, আড্ডা দেওয়া হতো না, তখন মোবাইল ফোনের মতো যোগাযোগের এত সহজ পদ্ধতি ছিল না বলে ওর সঙ্গে কথা হতো না, দেখাও হতো না। নিঃশব্দে ও হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে কিংবা আমি হারিয়ে গেলাম ওর জীবন থেকে।

জানি না, আমার এই বদলে যাওয়া এবং নীরবতা নিয়ে সে কী ভাবতো, কিন্তু আমি অনেকবার ভেবেছি ওর কথা। ভেবেছি, আমি আমার জীবনে আসা অপ্রত্যাশিত শ্রেষ্ঠ উপহারটি হারিয়েছি। কেবল রূপের জন্যই তো ওকে বিয়ে করা যায়। ওরকম সুন্দর একজন মানুষ জীবনসঙ্গী হলে জীবনের অর্ধেকটা এমনিতেই পূর্ণ হয়ে যায়, বাকিটাও চেষ্টা করে অর্জন করা সম্ভব। কী বললেন? বিপদও আছে? মৌ-লোভী মৌমাছির দল চারপাশে ঘুরঘুর করবে? আরে ভাই, ওটা বিপদ নয়, আনন্দ। ওরা ঈর্ষায় মরে যাবে, কিন্তু মধুর সন্ধান পাবে না, পাবো কেবল আমিই, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। ওরকম অভিজাত, রুচিশীল, পরমাসুন্দরী একটা মেয়েকে ঘরে আনতে গেলে ঘরে যে ধরনের আভিজাত্য, সচ্ছলতা, সৌন্দর্য, রুচিবোধ ইত্যাদি থাকা দরকার তা আমার ছিল না। হাহাকারে পূর্ণ মলিন একটা ঘরে একটা আলোকস্তম্ভ বসানো যায় না, তাতে দুটোকেই বেখাপ্পা লাগে। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের মধ্যবিত্ত দশা তখন ক্রমশ দারিদ্র্যের দিকে ধাবমান, আর আমি কোনোরকমে নিজেদের মধ্যবিত্ত মর্যাদাটুকু ধরে রাখার জন্য নিরন্তর লড়াই করে চলেছি।

গল্প আসলে এটুকুই। আগেই বলেছি, এখন বয়স হয়ে গেছে, বেলা পড়ে এসেছে। এখন আর অভাব নেই, দারিদ্র্য নেই, বরং যথেষ্ট সচ্ছলতা আছে। অল্প বয়সে বিভিন্ন জায়গায় যে মেধা, শ্রম, বুদ্ধি আর অল্পবিস্তর টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম, সেগুলো এখন কয়েকগুণ বেড়ে ফেরত আসছে। ভেবে পাই না, এত টাকা দিয়ে আমি করবো কী! এদিকে অতিরিক্ত পরিশ্রম আর মানসিক চাপের ফলে শরীরে নানা ধরনের রোগবালাই বাসা বেঁধেছে। মুখ বুজে বিবিধ যন্ত্রণা সহ্য করি। বলার মতো মানুষ তো নেই। একা থাকি, চুপচাপ থাকি, কথা বলি মনে মনে, তাও মৃত মানুষের সঙ্গে। বাবার সঙ্গে বলি, সবচেয়ে বেশি বলি মায়ের সঙ্গে। ওই যে শুরুতে যে বিনা কারণেই ববিতা আর ওয়াহিদের গল্প বলতে শুরু করেছিলাম, সেই ওয়াহিদকে ববিতা সিনেমার ডিভিডিটা দিতে পারেননি কেন জানেন? কারণ, ববিতা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেই ওয়াহিদের নম্বরে ফোন করে জানতে পারেন, ওয়াহিদ সেদিন সকালেই আত্মহত্যা করেছেন। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে, সাফল্য আর ব্যর্থতার চড়াই-উতরাই পেরোতে পেরোতে একসময় তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, জীবনের কাছে তার চাওয়ার কিছু নেই। তাঁর মনে হয়েছিল, পরাজিত হয়েছেন তিনি। কিংবা কে জানে, কী ভেবেছিলেন! একজনের আত্মহত্যার কারণ অন্য কেউ কখনো জানতে পারে না। মরার আগে মায়ের কাছে একটা চিঠিতে কেবল এইটুকু লিখেছিলেন তিনি – ‘আমার লাশটা কবর দিও না, তাতে খরচ বেশি, পুড়িয়ে দিও, মাত্র আটশো ডলার খরচ হবে। তোমার তো সেই সামর্থ্য আছে।’ আর কাউকে নয়, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে স্বেচ্ছামৃত্যুর আগে সে মাকেই লিখেছিল।

ব্যর্থ মানুষরা মায়ের কাছেই ফিরে ফিরে যায়। আমিও যাই। আমি কি ব্যর্থ? পরাজিত? কী জানি, ভেবে দেখিনি কখনো। তবে, এটুকু বুঝি, জীবনের কাছে আমারও চাওয়ার কিছু নেই, পাওয়ারও কিছু নেই। ওয়াহিদের মতো সাহস আমার নেই, সেজন্য নিজের জীবনের যতিচিহ্ন টানার কথাও ভাবতে পারি না। ক্লান্ত লাগে, অবসন্ন লাগে, প্রগাঢ় বিষাদে মন ভরে থাকে। কী করবো ভেবে না পেয়ে মাঝেমধ্যে মায়ের সমাধিতে গিয়ে বাঁধানো কবরের দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকি। বলি, মা, আমাকে তো কাজ দিয়ে গিয়েছিলে। তোমার ছেলেমেয়েদের দেখে রাখার কাজ। আমি তো দায়িত্বে অবহেলা করিনি। পড়াশোনা-চাকরি-বিয়ে সবকিছুতেই সহযোগিতা করেছি, ওদের সুন্দর সংসার হয়েছে, ওরা সুখে আছে। এবার আমাকে ছুটি দাও মা। আমার এখানকার কাজ শেষ হয়েছে, এবার তোমার কাছে নিয়ে যাও। তোমার কোলে শুয়ে ছোটবেলার মতো নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চাই। আমাকে নিয়ে যাও মা …

বলতে বলতে আমার কান্না পায়, নিজেকে বাধা দিই না, কাঁদি, আর অবিরল অশ্রুধারায় ভেসে যেতে যেতে সাড়াশব্দহীন মায়ের সঙ্গেই অবিরাম কথা বলে যেতে থাকি, অজস্র কথা …

শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খবর
© All rights reserved © 2024 Sylhetbela24.com
Theme Customized By BreakingNews