সুনামগঞ্জের শাল্লায় হাওরগুলোতে পাকা ধানের সোনালি শীষ বাতাসে দুলছে। বোরো ধান ভালো হওয়ায় কৃষকরা মহাখুশি। তবে, হাওরে ধান কাটার শ্রমিকের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর উপজেলার ছয়টি হাওরে বোরো আবাদ করা হয়েছে ২১ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমিতে কিন্তু শাল্লায় সরকারের দেওয়া ধান কাটার মোট ৩০টি হারভেস্টারের মধ্যে অধিক মুনাফা পাওয়ার লক্ষ্যে অনেক মেশিন রয়েছে অন্য জেলায়। মোট বোরো ফসলের তুলনায় ধান কাটার মেশিন ও শ্রমিক তুলনামূলক অনেক কম। এরমধ্যে কিছু মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়ারও তথ্য পাওয়া গেছে। আবার বেশ কয়েকটি মেশিন নিজ উপজেলার হাওরে ধান না কেটে অধিক মুনাফা পাওয়ার আশায় অন্য উপজেলায় গিয়ে ধান কাটছে। কিছু কিছু হারভেস্টার মেশিন অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়ারও গুঞ্জন রয়েছে।
স্থানীয়দের মধ্যে। তাই হারভেস্টার মেশিন ও শ্রমিক সংকটে কৃষকরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। তারা বলছেন, চোখের সামনে পাকা ধান দুলছে, অথচ ঘরে তুলতে পারছেন না। পাকা ধান কাটা হচ্ছে ধীরগতিতে। ৫০০ টাকার শ্রমিক হাজার টাকা দিয়েও মিলছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রমিক সংকট থাকা সত্ত্বেও অধিক মুনাফা পাওয়ার আশায় আটগাঁও ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের ফায়জুল হককে সরকারের দেওয়া কম্বাইন হারভেস্টারটি দিরাই উপজেলায় রয়েছে। ফায়জুল হকের সাথে কথা হলে তিনিও শ্রমিক সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন দিরাই ও শাল্লা উপজেলা মিলিয়ে ধান কাটছি। এদিকে কার্তিকপুর গ্রামের আব্দুল হক ও নাছিরপুরের ইকবাল তালুকদারের মেশিনটিও পার্শ্ববর্তী জেলার ধনপুর হাওরে রয়েছে বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার থেকে দুটি হারভেস্টার মেশিন পেয়েছেন আনন্দপুর গ্রামের আপন দুই ভাই ইউপি সদস্য বাবলু রায় ও পৃথেশ রায়। নীতিমালা উপেক্ষা করেই অধিক মুনাফা পাওয়ার লক্ষ্যে অন্য জেলাতে গিয়ে ধান কাটেন তারা। এবছরও কৃষকদের নিকট হতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা নিচ্ছে বলে জানান স্থানীয় কৃষকেরা।
এদিকে গত তিনদিন যাবত উপজেলার ভরাম, ছায়া, কালিয়ারকোটা ও ভান্ডাবিলসহ সবকটি হাওর পরিদর্শন করেছেন এই প্রতিবেদক। সেসব হাওর ঘুরে দেখা গেছে, স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীসহ পরিবারের লোকজন প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে তারা ধান কাটছেন। কোনো কোনো গৃহস্থরা শ্রমিকদের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ধান কাটাচ্ছেন। কারণ প্রত্যেক হাওরের অধিকাংশ ধানই ৮০ ভাগ পরিপক্ব। সেজন্য শ্রমিকদের অতিরিক্ত টাকা বা ধান দিয়েও ধান কেটে নিচ্ছেন কৃষকরা। মাঝে মধ্যে হাওরে হারভেস্টার মেশিন দেখা গেলেও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এগুলো অধিকাংশ মেশিন ভাড়াটে। তাই একর প্রতি টাকাও নিচ্ছে বেশি। উপজেলার ছায়ার হাওরে আটগাঁও ইউনিয়নের মাহমুদনগর গ্রামের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি হারভেস্টার মেশিনের দেখা মিললে অন্য হাওরে সরকারি কোনো হারভেস্টার মেশিনের দেখা মেলেনি। ধান কাটার শ্রমিক ও মেশিন না পেয়ে হাওরে কৃষকদের দিশেহারা অবস্থায় দেখা গেছে।
উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়নের কালিয়ারকোটা হাওর সংলগ্ন সোনাকানী গ্রামের সামনে মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক-কৃষাণীরা একসঙ্গে রোদে ধান শুকাচ্ছেন। কেউ কেউ ধান মাড়াই করছেন। তাদের মধ্যে কোনো ক্লান্তি নেই।
কথা হয় এ হাওরের কৃষক মিনহাজ আহমেদের সাথে। তিনি বলেন, সোনালি ফসল ঘরে তুলতে তাদের কোনো কষ্ট নেই। এক বৈশাখ মাস হাসিমুখে কষ্ট করে সারা বছর বসেই খান তারা। তিনি বলেন, শ্রমিকের সংকট থাকায় পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে একটি ধান কাটার হারভেস্টার মেশিন এনেছি। নিজের জমির পাশাপাশি অন্যের জমিও তিনি কেটে দিচ্ছেন বলে জানান।
ভরাম হাওরের সবচেয়ে বড় কৃষক আরিজ মিয়া বলেন, ‘কি বলবো ভাই! আমি ৪০ একর জমি চাষ করেছি। বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু শ্রমিক না পাওয়ায় পাকা ধানও কাটতে পারছি না। আমাদের এলাকায় শ্রমিক ও হারভেস্টার মেশিন না থাকায় হবিগঞ্জ থেকে একটি মেশিন এনেছি। আবহাওয়া ও প্রকৃতি সহায় থাকলে দুই থেকে আড়াই হাজার মণ ধান তিনি পাবেন বলে জানান।
কৃষি কর্মকর্তা মো. সৈকত জামিল কিছুটা শ্রমিক সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, গত সাত তারিখ হতে ধান কাটা শুরু হয়েছে, এই পর্যন্ত ৩ হাজার ৭শ হেক্টর জমিতে ধান কাটা হয়েছে। জানতে চাইলে ধান উৎপাদনের হিসেব তিনি দিতে পারেননি। তিনি বলেন, প্রকৃতি ও আবহাওয়া অনূকূল থাকলে এ বছর উৎপাদিত ধান থেকে ৯৫ হাজার ৫শ ৯৮ মেট্রিকটন চাল পাওয়া যাবে, যার বাজারমূল্য ৫২৬ কোটি টাকা।