নীরব চাকলাদার :
সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদী। এই নদীর পাড় ঘেঁষেই একদিকে অদ্বৈত বাড়ি অপরদিকে শাহ্ আরেফিন (র.) মাজার। যার ফলে প্রতি বছরই একটি নির্ধারিত তারিখে যাদুকাটার পাড়ে সম্মিলন ঘটে হিন্দু-মুসলমানদের। মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে তাহিরপুরের প্রান্তিক জনপদ। কিন্তু নদীর দু’তীরের বালু কেটে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে একটি চিহ্নিত চক্র। দিনে-রাতে পাড় কেটে অব্যাহত বালু উত্তোলনের কারণে এখন হুমকীর মুখে অদ্বৈত বাড়ি ও শাহ্ আরেফিন (র.) মাজার।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় ল্উায়েরগর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে ছোট একটি খাল ছিল, ওখান থেকে ওরা বালু তুলতে তুলতে, খালকে বড় নদীতে পরিণত করেছে। এখন লাউড়েরগড় আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ও পড়েছে হুমকির মুখে।
জানাগেছে নদীর পাড় রক্ষায় নিয়মিত পাহাড়া চলে। তবুও থামানো যাচ্ছে না অবৈধ বালু উত্তোলন। চোখের নিমিষেই হাজার হাজার ফুটের নৌকায় বালু বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র। প্রভাবশালী চক্রের মূল হোতা স্বেচ্ছাসেবক লীগের জেলা সহসভাপতি রাজারগাঁওয়ের জাঙ্গালহাটির বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন ও ডালারপাড়ের শাহেদ মিয়ার ছেলে শাহানশাহ। তাদেরই নির্দেশে শ্রমিকরা এখানকার পাড় কাটছে বহুদিন ধরে।
রাজারগাঁওয়ের বাসিন্দা আরাফাত মিয়া বলেন, গ্রামে নারী-পুরুষ মিলে এখন পাহারা চলে। তিনজন পুলিশও থাকে এখানে। তবে সন্ধ্যা হলেই নামে তাণ্ডব, পুলিশ যখনই সরে বা বদল হবার জন্য এখান থেকে চলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে একাধিক নৌকা লাগিয়ে বোমা মেশিন বা পাড় কাটা মেশিন লাগিয়ে চার পাঁচ হাজার ফুটের নৌকা ভরাট করে নিয়ে যায় এরা। এভাবে কাটতে থাকলে, দেখতে দেখতে অদ্বৈতবাড়ী থেকে শাহ্ আরেফিন (র.) মাজারমুখী সড়ক নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। বিলীন হবে নদীগর্ভে যাবে অদ্বৈত বাড়িও।’
স্থানীয়দের দাবি, বোরহান ও শাহান শাহ্ কে গ্রেপ্তার করে শায়েস্থা না করলে এই পাড় কাটা রোধ হবে না। আগের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এদের সমালোচনা করার সাহসই কারো ছিল না। এখনো নেই। পাড় কেটে বালু বিক্রয় করেই এরা কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছে।
গ্রামের সিরাজুল ইসলাম বললেন, এসব নিয়ে কথা বললেই মারামারি, পুলিশ কখন আসে, কখন যায় সবই তাদের জানা থাকে। পুলিশ না থাকলেই নৌকা লাগিয়ে মেশিন দিয়ে শুরু হয় পাড় কাটা। সড়কের পাশে এসে শুক্রবারও মেশিন লাগিয়েছিল তারা। এই সড়ক ভাঙলে, মন্দিরও যাবে নদীতে। যাদুকাটায় শতকোটি ব্যয়ে শাহ্ আরেফিন—অদ্বৈত সেতু’র কাজ চলছে। এভাবে বালু কাটতে থাকলে এই সেতুও পড়বে হুমকিতে।
গ্রামের বাসিন্দা ও অদ্বৈত মন্দির পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি মধুসুদন রায় গেল দুই—তিনদিনে নদীর পাড় কাটার ভয়াবহতা দেখিয়ে বললেন, প্রশাসন এসে দুয়েকজনকে ধরে নিলেও, যারা পাড় কাটার গডফাদার তাদের কাজ তারা ঠিকই চালায়। গডফাদারদের শাস্তি না দিলে, এই পাড় কাটা থামবে না।
দুইঘণ্টা রাজারগাঁও এলাকায় অবস্থানকালে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বললেন, পাড় কাটার সঙ্গে জড়িত সকলেই রাজারগাঁও জাঙ্গালহাটির বোরহান এবং ডালারপাড়ের শাহানশাহ এর লোকজন। তারাই, মালেক, জামাল, রতন, কবির ও বিল্লালসহ কিছু লোককে দিয়ে এসব করায়।
গ্রামের কিছু তরুণ বললেন, বোরহান উদ্দিন স্বেচ্ছাসেবক লীগ করলেও তার ভাই আব্দুল মালেক বিএনপি’র সঙ্গে জড়িত। নদীর পাড় কাটার সময় বোরহানের পাশাপাশি আব্দুল মালেকও সক্রিয় থাকে।
অভিযোগের বিষয়ে বোরহান উদ্দিন বলেন, আমি পাড় কাটার সঙ্গে জড়িত হলে গেল শুক্রবারও মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায়ের পর এই পাড় কাটা নিয়ে সকলকে সচেতন হবার কথা বলতাম না।
অভিযুক্ত অপর ব্যক্তি শাহানশাহ জানান, আমরা বালুর ব্যবসা করি। কিন্তু ওখানকার পাড় আমরা কাটি নি। যে কয়েকজন আমার কথা বলে, প্রকৃতপক্ষে তারাই পাড় কেটে বালু নিয়ে বিক্রয় করছে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম বললেন, রাজারগাঁও, অদ্বৈতবাড়ি, লামাশ্রম, শাহ আরেফিন—অদ্বৈত সেতু এলাকায় যাদুকাটার পাড় কাটা ঠেকাতে কয়েকদিন অভিযান হয়েছে, কয়েকজনকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তবু থামানো যাচ্ছে না ওখানকার পাড় কাটা। বোরহান উদ্দিনসহ কয়েকজনের নামোল্লেখ করে তিনি বললেন, এসব অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় না আনলে পাড় কাটা ঠেকানো যাবে না। বিষয়টি পুলিশ সুপারকে জানাবো আমি। এই বিষয়ে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হবে বলেও মন্তব্য করলেন এই কর্মকর্তা।