জাতীয় ঐক্যের জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন চর্চা। গণতন্ত্রের সংগ্রাম বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে। এ সংগ্রামে কোন দাড়ি, কমা কিংবা সেমিকোলন নেই। গণতন্ত্রের সংগ্রামের সব চেয়ে বড় উপাদান হলো সহিষ্ণুতা। আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্রের কোন বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি; তাই পৃথিবীর সকল দেশেই গণতন্ত্রের সংগ্রাম অব্যাহত আছে। প্রশ্ন হলো, উত্তর কোরিয়ার একনায়কতান্ত্রিক সরকার কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের রাজা, বাদশাহ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় কী গণতন্ত্রের সংগ্রাম জারি আছে। ওই যে রুশোর সেই অবিস্মরণীয় উক্তি সে উক্তিটি স্মরণ করুনÑ ‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন কিন্তু সমাজ তাকে শৃঙ্খলিত করে।’
শৃঙ্খলিত অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষের মুক্তির সংগ্রাম চলতেই থাকে। সেটি উত্তর কোরিয়াতে, মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের শৃঙ্খলিত সমাজ কিংবা রাষ্ট্রতেই হোক না কেনো। কঠিন শৃঙ্খলে সমাজ যেখানে অন্তরীন সে সমাজে গণতন্ত্রের লড়াই কিছু সময় কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। লড়াই যখন তীব্রতর হতে থাকে তখন মানুষের কাছে এ লড়াই দৃশ্যমান হতে থাকে। মূলত রাষ্ট্রের কাছে সকল নাগরিকের সমদৃষ্টি, সমসুযোগ, সমঅধিকার লাভের নিরন্তর আকাক্সক্ষা থেকেই এ লড়াই চলতে থাকে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। একটি রাষ্ট্রে বা সমাজে সকল নাগরিক, সক্রিয় সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমস্ত বিষয়ে ঐকমত্য থাকবে তা আশা করা যায় না। তাছাড়া গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো ভিন্নমত। গণতান্ত্রিক সমাজে আদর্শ ও নীতিগত বৈচিত্র্য থাকতেই হবে। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো সকল বিষয়ে প্রান্তিক অবস্থায় থাকা নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব ও সুযোগ নিশ্চিত করা।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ঐক্য, সংহতি কিংবা জাতীয় মৌল বিষয়ে নাগরিকদের দ্বারা তৈরি রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে ঐকমত্যের বিষয়টি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে হতাশ হতে হয়। যে ইস্পাত কঠিণ জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিলো সে ঐক্যের কথা ভাবলে এখন বিষন্ন হতে হয়। শুধু বিষণœই নয় সামাজিক অস্থিরতা, সমাজে বিদ্যমান সহিংসতা, তীব্র মত ভিন্নতা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বাংলাদেশের নাগরিকদের হতাশ না করে পারেনা। চুয়ান্ন বছর বয়সি বাংলাদেশের মানুষের পরিপূর্ণ শৃঙ্খল মুক্তির আন্দোলনে আমরা কখন মোটামোটি সন্তোষজনক একটি মাইলস্টোনে পৌঁছতে পারবো, সে বিষয়ে আমাদের নাগরিক কিংবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কোন ধারণা আছে বলে মনে হয় না।
সামাজিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খল অবস্থাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও বহমান সময়ে তা অনেক সময় সম্ভব হয়ে উঠেনা। দেশজুড়ে অসহিষ্ণুতা এখন দৃশ্যমান। ছোট-বড় শহরে মানুষের মধ্যে বিভাজন রেখা গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয় না। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে আমরা নানা ভাগে নিজেদের বিভক্ত করে ফেলেছি। নয়া বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন সমাজ গড়তে হলে জাতীয় সংহতির যে কোন বিকল্প নেই এ কথাটি অস্বীকার করবো কিভাবে। একাত্তরে বজ্র কঠিন ঐক্য হয়েছিলো বলেই আধুনিক সমরাস্ত্রের সামনে মানুষ বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। সপ্তম নৌবহর ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলো সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐক্য এবং দেশপ্রেমের শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্রকে লক্ষ্য করে। গণতন্ত্রের মেরুদ- হলো সহিষ্ণুতা। গণতন্ত্রের কথা উচ্চারণ করলেই মহামতি ভলতেয়ারের সেই মহান উক্তি মনের ভেতরে ঘোরাফেরা করতে থাকে। এই অসাধারণ উক্তিটি আমরা বহুল ভাবে ব্যবহার করে থাকি কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে তার ব্যবহার খুব যে বেশি হয়না তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কী বলেছিলেন ভলতেয়ার, তার অমর কথাটি ছিলো এরকম ‘আমি তোমার মতামতের সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার মতামত প্রকাশের অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবনও দিতে পারি। ‘ও যিড়ষষু ফরংধঢ়ঢ়ৎড়াব ড়ভ যিধঃ ুড়ঁ ংধুÑধহফ রিষষ ফবভবহফ ঃড় ঃযব ফবধঃয ুড়ঁৎ ৎরমযঃ ঃড় ংধু রঃ.’ সহিষ্ণুতার এই বাণীটির ধারে কাছে কী আমাদের অবস্থান আছে, বুঝতে কষ্ট হয়।
সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করতে হলে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চাকে সংস্কৃতি হিসেবে ধারণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের চর্চা শুরু না করে, তাহলে গণতন্ত্র শুধুই শাসনের একটি আড়ম্বরপূর্ণ শব্দ হয়ে থাকবে। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে স্বাধীনতা লাভ করেছি সে স্বাধীনতা দেশের অভ্যন্তরে কিছু ক্ষমতাশালী মানুষের অধীনতায় পর্যবসিত হবে। প্রান্তিক মানুষের স্বাধীনতাকে অধিকার হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন অমর্ত্য সেন। তিনি স্বাধীনতাকে ইতি এবং নেতি দুইভাবেই দেখেছেন। স্কুলে যাওয়ার অধিকারকে প্রফেসর সেন নেগেটিভ ফ্রিডম বলছেন। এখানে রাষ্ট্রের, সংগঠনের বা ব্যক্তির কাছে থেকে বাধা নেই, কিন্তু বাধা না থাকাই যথেষ্ট নয়। যার স্কুলে বেতন দেওয়ার, বই কেনার টাকা নেই, সে এই স্বাধীনতা দিয়ে কী করবে? সেজন্য তিনি বলছেন, নেগেটিভ ফ্রিডম হলো প্রয়োজনীয় শর্ত; কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। পজিটিভ ফ্রিডমের মানে হলো আপনি যা মূল্যবান মনে করেন, তা করার বা হওয়ার বাস্তব সক্ষমতা থাকা। এটি শুধু স্বাধীনভাবে থাকতে পারার বিষয় নয়, এটি ক্ষমতায়নের বিষয়।
কথায় কথায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের ক্ষমতায়নের কথা বলে থাকে। মানুষ ক্ষমতায়িয় হয় কিভাবে? একটি কথা স্বতসিদ্ধ তা হলো, গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দেশে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো যদি প্রান্তিক মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার নামে ক্ষমতায়িত মানুষের প্রত্যাশাকে সবার সামনে নিয়ে আসে তাহলে ক্ষমতায়নের নামে প্রান্তিক মানুষদের ক্ষমতা কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রশ্ন হলোÑ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কী আমরা দেখতে পাই। দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় না।
‘প্রান্তিক মানুষের ইচ্ছা’, প্রান্তিক মানুষের আকংখার নামে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ইচ্ছাকে ‘জাতীয় ইচ্ছা’ বা ‘জাতির ইচ্ছা’ হিসেবে উত্থাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক শ্রেণির স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবিসমূহ যদি রাষ্ট্র মেনে না নেয় তাহলে প্রান্তিক মানুষ কিংবা গণমানুষের দাবির নামাবলী পরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। প্রান্তিক মানুষেরা যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত না থাকে তাহলে তাদের মতামত, দাবি, জাতীয় নীতি প্রণয়নে কিভাবে প্রতিফলিত হবেÑ এ বিষয়টি তারা মাথায় রাখেন বলে মনে হয় না।
রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমঅধিকার, সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন রাজনীতির এই পুরোনো সংস্কৃতি; যাকে পুরোনো বন্দোবস্ত বলা হয় সেই স্থিতাবস্থার খোলনলচেকে বদলে ফেলা। এ কাজটি যদি করা না যায় যতই নতুন বন্দোবস্তের কথা বলা হোক না কেন বন্দোবস্তটির গন্তব্য হবে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষের বাড়ির অন্দরমহল।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে আমরা অনেককে স্লোগান দিতে শুনতামÑ ‘এ সমাজ ভাঙ্গতে হবে, নতুন সমাজ গড়তে হবে’, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই এ লড়াইয়ে জিততে হবে’Ñ এসব স্লোগান যারা উচ্চস্বরে তুলতেন, তারা অনেকেই আমাদের বন্ধু ছিলেন। জিজ্ঞেস করেছি তাদের বহুবার, সমাজ যদি ভেঙে যায় নতুন করে সমাজ গড়া হবে কী করে। তার উত্তর হয় ধারণা থেকে পেয়েছি কিংবা চরম কোন তত্ত্বের অস্পষ্ট ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। ভাঙার পর গড়ার বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট পথ নকশা ছিলো না। ভাঙার আগেই গড়ার বিষয় নিয়ে যে ভাবতে হবে সে বিষয়ে তারা ছিলেন উদাসীন। মনে রাখতে হবে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র নিয়ে ছেলে খেলা চলে না। গড়ার প্রক্রিয়া না জানলে সমাজকে ভেঙে ফেললে ভঙ্গুর, বিশৃঙ্খল সমাজ, পঙ্গু সমাজ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। নাগরিকের সমানাধিকারের সমাজ, নায্য ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে চাই গণতন্ত্রের সৎ ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা। পারবো কি আমরা সেই পথে এগোতে?
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]