মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। জেলার মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার অবস্থিত এই হাওরে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরনা) এসে মিশেছে। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ১২,৬৬৫ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি।
একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে ‘রামসার স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। সুইস অ্যাজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) এবং আইসিইউএন ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ‘টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্প পরিচালনা করছে।
এবার সেই হাওরে আরও একটি প্রকল্প গ্রহণ করলো সরকার। ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে টাঙ্গুয়ার হাওরকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে একটি নতুন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। গত ১৩ মে রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে “কমিউনিটি-ভিত্তিক টাঙ্গুয়ার হাওর জলাভূমি ব্যবস্থাপনা” শীর্ষক পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।
প্রায় ৪.০৫ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে এই প্রকল্পটি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হবে। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) অর্থায়িত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে স্থানীয় জনগণকে স¤পৃক্ত করে টাঙ্গুয়ার হাওরের জলাভূমি ও বাস্তুতন্ত্রের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, জলাবন ও জলজ বাসস্থান পুনরুদ্ধার করা এবং বিকল্প পরিবেশবান্ধব জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করা।
এ বিষয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, কমিউনিটিকে ক্ষমতায়ন করাই পরিবেশগত স্থায়িত্বের চাবিকাঠি। টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু সুনামগঞ্জের সম্পদ নয়, এটি আমাদের সবার। স্থানীয় প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে এই প্রকল্প বিশ্বে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের একটি মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে। জিইএফ-কে ধন্যবাদ জানাই তাদের অব্যাহত সহায়তার জন্য।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইউএনডিপি বাংলাদেশ-এর রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ স্টেফান লিলার বলেন, গত কয়েক বছরে ইউএনডিপি, জাতীয় অংশীদারদের সঙ্গে মিলিতভাবে জিইএফ-এর সহায়তায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি উন্নয়ন সহায়তা এনেছে, যা বাংলাদেশের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন অগ্রাধিকারগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। টাঙ্গুয়ার হাওরের এই নতুন প্রকল্প পূর্ববর্তী সাফল্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যাবে এবং সরকার, কমিউনিটি, সিভিল সোসাইটি ও প্রাইভেট সেক্টরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।” তিনি আরও বলেন, “এই প্রকল্পে স্থানীয় বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে ঝুঁকি-বিবেচনায় নেওয়া সংরক্ষণ পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক মূল্যায়ন ও স্কেলযোগ্য প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় জ্ঞানের অন্তর্ভুক্তি এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান, এনডিসি, কর্মশালার সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, কমিউনিটির স¤পৃক্ততার মাধ্যমে সমন্বিত জলাভূমি ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ অধিদপ্তর নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্প শুধু প্রকৃতি সংরক্ষণ নয়, এটি জনগণের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, প্রকল্পটি সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওর পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং সরাসরি ৩,০০০ এর বেশি মানুষ উপকৃত হবেন, যেখানে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা হবে। প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১,৫০০ হেক্টরের বেশি বন ও জলজ বাসস্থান পুনরুদ্ধার, জীববৈচিত্র্য অভয়ারণ্য স্থাপন, মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজ ও নারী-সংবেদনশীল এমএসএমই-সমূহকে সহায়তা, জলাভূমি-ভিত্তিক কৃষি ও মৎস্য চাষ এবং দায়িত্বশীল পর্যটনকে উৎসাহিত করা।
এছাড়া প্রকল্পে জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ, বায়োডাইভারসিটি ফাইন্যান্স এবং জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিংয়ের ওপর জোর দেওয়া। যা জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা এবং গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্কের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কর্মশালায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থা, ইউএনডিপি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, এনজিও, বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ১১০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন।